ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

প্রথম আলোর মাদার কোম্পানি ট্রান্সকমের দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির জালিয়াতি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ৭ এপ্রিল ২০২৩  

প্রথম আলোর মাদার কোম্পানি ট্রান্সকমের দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির জালিয়াতি

প্রথম আলোর মাদার কোম্পানি ট্রান্সকমের দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির জালিয়াতি

যে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার দেশের মানুষকে নিয়মিত ন্যায়-নীতির সবক দেয়, প্রকৃতপক্ষে তাদের সে প্রদীপ পুরোটাই গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। পত্রিকা দুটির মাদার কোম্পানি ট্রান্সকমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, দখলদারি, শুল্ক ফাঁকি দেয়া ও মানি লন্ডারিংসহ বহু অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক লতিফুর রহমান ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বহু মামলা চলমান ছিল। এজন্য তাকে বেশ কয়েকবার দুদক কার্যালয়ে হাজির হতে হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও হয়েছেন। ট্রান্সকম গ্রুপভুক্ত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার এবং অবৈধ উপায়ে সরকারি জমি দখলে রাখার অভিযোগ রয়েছে লতিফুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে।

উল্লেখ্য, ট্রান্সকম গ্রুপের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ট্রান্সকম ফুড লিমিটেড, ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক লিমিটেড, ট্রান্সকম কাস্টমার প্রডাক্টস লিমিটেড, বাংলাদেশ ল্যাম্পস লিমিটেড, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেড (যার অধীনস্ত প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনা সংস্থা), টি হোল্ডিং লিমিটেড, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, ট্রান্স ক্র্যাফট লিমিটেড, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ট্রান্সকমের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে বেভারেজ, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইলেকট্রনিকস, ভোগ্যপণ্য, শিশুখাদ্যসহ বিভিন্ন খাতে। এছাড়া লতিফুর রহমান আমৃত্যু ছিলেন নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশে পেপসি, কেএফসি, পিজা হাটের ব্যবসাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণে।

এই কর্পোরেট জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বহু অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ কিন্তু সাম্প্রতিক নয়। তাদের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে জমেছে এসব অভিযোগ। এসব নিয়ে বহু পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। এসব কারণে অনেক পত্রিকা ও প্রতিবেদকদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বাংলানিউজ ট্রান্সকম গ্রুপের দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন করেছিল ২০১২ সালে। সে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আসুন সেই প্রতিবেদনটি দেখা যাক।

বছরের পর বছর ধরে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি করার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি চালিয়ে যাচ্ছে দেশের অন্যতম র্শীষস্থানীয় ব্যবসায়ী লতিফুর রহমানের মালিকানাধীন ট্রান্সকম গ্রুপ। কখনও এক পণ্যের ঘোষণা দিয়ে আরেক পণ্য আমদানি আবার কখনও ঘোষণায় আমদানি মূল্য কম দেখানোর মধ্য দিয়েই চলছে ট্রান্সকমের জালিয়াতি। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এভাবে মিথ্যা ঘোষণায় ট্রান্সকম গ্রুপের পণ্য আমদানির বিষয় বিভিন্ন সময় কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কাছেও ধরা পড়েছে। এরপর তদন্ত কিংবা সাময়িক কিছু আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বারবার থেমে গেছে কিংবা ধামাচাপা পড়ে গেছে ট্রান্সকমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া।

চট্টগ্রাম বন্দরে ট্রান্সকম গ্রুপের দুটি সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয় ২০১০ সালে। ওই বছরের ৬ই এপ্রিল বন্দরের সিসিটি ইয়ার্ডে ট্রান্সকম গ্রুপের নামে আমদানি করা ৪টি কনটেইনারের একটি চালান আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। “কম্প্রেসার” নামে যন্ত্রাংশ ঘোষণায় ওই চালানে ট্রান্সকম গ্রুপ আমদানি করে ৫৪০ ইউনিট এয়ার কন্ডিশনারের আউটলেট (যা ঘরের বাইরে স্থাপন করা হয়)। চট্টগ্রাম কাস্টমসের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে পূর্ণাঙ্গ পণ্যকে যন্ত্রাংশ হিসেবে আমদানির ঘোষণা দেয়।’

কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ওই সময় ট্রান্সকম গ্রুপ চালানে আনা পণ্যকে তাদের নয় বলে দাবি করেছিল। তবে এসব আউটলেটের গায়ে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘ট্রান্সটেক’। কাগজের বাক্সেও লেখা ছিল ‘ট্রান্সটেক’। ইংরেজিতে আরো লেখা ছিল মার্কেটেড বাই ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড। দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী লতিফুর রহমানের মালিকানাধীন ট্রান্সকম গ্রুপের লোগোও ছিল এতে। পরে কাস্টমস কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তদন্তে নামেন।

সেসময় কর্মকর্তারা নগরীর শেখ মুজিব রোডস্থ এসএস টাওয়ারে ট্রান্সকমের শো-রুমে গিয়ে দেখতে পান, ট্রান্সটেক ব্র্র্যান্ডের এয়ার কন্ডিশনার সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রির উদ্দেশে। বন্দরে আটক এয়ার কন্ডিশনার আউটলেটের সঙ্গে শো-রুমে রাখা আউটলেটের হুবহু মিল পান তারা। আর শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমস কর্মকর্তারা তদন্তে ওই আমদানি চালানেও ব্যাপক গরমিল পান। কারণ, আমদানি ঘোষণায় পণ্যের মূল্য দেখানো হয় ২০,৭২৭.২০ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৪০ টাকা)। অর্থাৎ শুল্ক পরিশোধের আগে প্রতিটি এয়ার কন্ডিশনার আউটলেটের মূল্য দেখানো হয় মাত্র ২,৬৬৮ টাকা!

কাস্টমস সূত্র জানায়, আমদানিকৃত ৪ কন্টেইনার পণ্যের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এসির যন্ত্রাংশ হিসাবে। কিন্তু তাদের কাছে গোপন খবর ছিল এসবই পূর্ণাঙ্গ পণ্য, কেবল এসির কম্প্রেসার সংযুক্ত নেই। যন্ত্রাংশের শুল্ক ১২৫ শতাংশ আর পূর্ণাঙ্গ পণ্যের শুল্ক ১৪৯ শতাংশ।

এভাবেই ট্রান্সকম গ্রুপ মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বড় ধরনের জালিয়াতির এ ঘটনা পরবর্তী সময়ে ট্রান্সকম গ্রুপ ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। এ নিয়ে পরে আর কোন উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।

এর আগে ২০১০ সালের শুরুতে ট্রান্সকম গ্রুপ একই পদ্ধতিতে ফিলিপসের ইলেক্ট্রনিক পণ্য আমদানি করে। ইলেক্ট্রনিক পার্টস ও এক্সেসরিজ ঘোষণা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইলেক্ট্রনিক পণ্য আমদানি করায় সেসময়ও তাদের একটি চালান আটক করেছিল শুল্ক-গোয়েন্দা বিভাগ। পরে ওই চালানের মাধ্যমে ট্রান্সকম গ্র“পের ৬ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির বিষয় ধরা পড়ে। এ নিয়ে আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন আছে। এই তথ্য জানা গেছে বলে কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে।

ট্রান্সকম বেভারেজের বিরুদ্ধে তাদের পরিবেশিত পেপসিকোর কোমল পানীয় ব্র্যান্ড মাউন্টেন ডিউ ও সেভেন আপ বোতলজাতে বিএসটিআই’র নীতিমালা না মানার অভিযোগ উঠেছিল। বাংলানিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-

মাদার কোম্পানি আমেরিকার পেপসিকো’র লাইসেন্সে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ওই দু’টো বিশ্বখ্যাত পানীয় বোতলে ভরে বিক্রি করলেও এর গায়ে দরকারি তথ্য নেই। বিএসটিআই’র ‘স্পেসিফিকেশন ফর বেভারেজ ওয়াটার’ এর নিয়ম অনুযায়ী কার্বনেটেড পানীয়তে কি ধরনের রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত রয়েছে তার উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু বাজারে মাউন্টেন ডিউ এবং সেভেন আপ-এর কোনো বোতলেই তা দেখা যায়নি।

‘স্পেসিফিকেশন ফর বেভারেজ ওয়াটার’-এর ৩ ধারায় উল্লেখ করা আছে, কার্বনেটেড পানীয়তে প্রতি লিটারে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ০.০১ মিলিগ্রাম। প্রতি কিলোগ্রামে লেডের সহনীয় মাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম। কপারের সহনীয় মাত্রা লিটারে ১ মিলিগ্রাম। আয়রনের সহনীয় মাত্রা প্রতি কিলোতে ১০মিলিগ্রাম। কিন্তু বাজারে মাউন্টেন ডিউ ও সেভেন আপ-এর যেসব কাঁচের বোতলে বিক্রয় হচ্ছে তাতে কোনো তথ্যই দেয়া নেই। এমনকি যেসব পিইটি (প্লাস্টিক) বোতল বিক্রি হচ্ছে সেগুলোতেও সুনির্দিস্টভাবে উপাদান সংক্রান্ত তথ্য লেখা হয়নি। এসব তথ্য ক্রেতাকে না জানানোর ফলে ভোক্তা অধিকার আইন যেমন লঙ্ঘন হচ্ছে তেমনি ভোক্তার কাছেও অজানা থাকছে তার শরীরের জন্যে এগুলো পান করা সঠিক হচ্ছে কি না।

বিএসটিআই-এর ওজন বিধিমালা ২০০৭ অনুযায়ী পণ্যের মোড়ক বা বোতলের ওপর ওজন লেখা থাকতে হবে। মাউন্টেন ডিউতে ২০০ মি.লি লেখা থাকলেও মেপে দেখা গেছে কয়েক মি.লি কম রয়েছে। উৎপাদনের তারিখ এবং বাতিল হওয়ার মেয়াদ স্পষ্টভাবে লেখার কথা থাকলেও তা এমনভাবে লেখা রয়েছে যার কারণে ক্রেতার পক্ষে মেয়াদ দেখা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

বিএসটিআই-এর নিয়মানুযায়ী কার্বনেটেড পানীয়ের বোতলের গায়ে সতর্কীকরণ বার্তা থাকতে হবে। যাতে উল্লেখ করা থাকবে- কোন কোন রোগীরা এ পানীয় পান করতে পারবে না। কিন্তু অন্য ৮টি পানীয়ের মতো এ দু’টোতেও নিয়ম মানছে না ট্রান্সকম বেভারেজ।

পণ্যের লাইসেন্স সংক্রান্ত আইন ১৯৮৫ অনুযায়ী নিয়ম না মেনে বাজারে বিক্রি করায় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ৪ বছরের জেল এবং ৭ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে বলে জানান বিএসটিআই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর নূরুল আমিন। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী কার্বনেটেড পানীয়ের বোতলের গায়ে রাসায়নিক উপাদানের নাম উল্লেখ না করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এছাড়াও ‘স্পেসিফিকেশন ফর বেভারেজ ওয়াটার’ এর যে কোনো একটি নিয়ম না মানলেই সে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনেও বিচার হতে পারে বলে জানান তিনি।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে ট্রান্সকম বেভারেজের বক্তব্য জানতে তাদের ফ্যাক্টরিতে ফোন করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চান বাংলানিউজের প্রতিবেদক। তখন কথা বলতে চাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন অপারেটর। কারণ বলার পর তিনি ফোন রেখে দেন। এরপর ফোন দিলে তা আর রিসিভ করেননি অপারেটর।

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়