ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

ময়মনসিংহের ‘বউ বাজার’, ১৩০ টি দোকানের মালিক নারীরাই

ফিচার ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ১৯ অক্টোবর ২০২০  

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

রাঙামাটির ‘বনরূপার বাজার’ সম্পর্কে অনেকেই জানেন! যেখানে নারীরাই বাজার চালায়। নেই কোনো পুরুষ দোকানি বা বিক্রেতা। শুধু নারীদের রাজত্ব বাজার জুড়ে। 

ঠিক তেমনই ‘বউ বাজার’, ময়মনসিংহের নারীদের ভাগ্য বদলাচ্ছে। এই বাজারে সব নারীরাই দোকানি ও বিক্রেতা। 

শুরুটা হয় ৩০ বছর আগে। ময়মনসিংহের কৃষ্টপুর এলাকায় নিম্ন আয়ের দুই কলোনি ঘিরে। মালঞ্চ ও আদর্শ নামে এই দুই কলোনি। গড়ে উঠেছে সিটি কর্পোরেশনের জমিতে।

এখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই দিনমজুর অথবা রিক্সাচালক। প্রত্যেকেরই টানাটানির সংসার। নিত্য অভাব। এই অভাব থেকেই পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে কলোনির নারীরা এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কয়েকজন নারী নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন কলোনি এলাকায় একটি বাজার শুরু করার। এই বাজারের ব্যবসায়ী হবেন শুধুই নারীরা।

এভাবেই শুরু হয় ‘বউ বাজার’। পাঁচ-ছয়জন নারীর ছোট দোকান থেকে এখন পুরো বাজারে দোকানের সংখ্যা ১৩০। শুরুর সেই বৈশিষ্ট্য এখনো কঠোরভাবে বজায় রেখেছেন তারা। এখনো বাজারের সব দোকানিই নারী। তারাই ব্যবসার মালিক।

তেবে কেউ অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাজারের নাম দেননি। লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গেছে ‘বউ বাজার’। এই বাজারে মাছের দোকান চালান ষাটোর্ধ্ব জাহান বেগম। 

বউ বাজার যখন শুরু হয়, তখন তার ঘরে ছোট ছোট তিন সন্তান। স্বামীর রোজগারে সংসার চলত না। তাই তিনি কলোনির এই খোলা জায়গায় অন্যদের সঙ্গে দোকান শুরু করেন। 

শুরুতে সবজির দোকান চালিয়েছেন। তখন পুঁজি কম ছিল। তাই শহরের কাঁচা বাজার থেকে কম টাকায় সবজি কিনে এনে অল্প লাভে বিক্রি করতেন।

ধীরে ধীরে তার ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে। এক সময় তিনি সবজি ব্যবসা বাদ দিয়ে আরও বেশি পুঁজি নিয়ে মাছ বিক্রি শুরু করেন। 

বর্তমানে মাছের দোকানে তার প্রতিদিন বিক্রি হয় ছয় হাজার টাকার উপরে। আগে জাহান বেগম দোকান চালাতেন একাই। এখন অবশ্য তার সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেন তার নাতিরা।

বাজারের পাশে শুটকির দোকান হালিমা আক্তারের। তিনি মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে ১০ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেন। শুরুতে তাকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে। 

স্বামীর অমতে অনেকটাই জোর করে ব্যবসা শুরু করেন ‘বউ বাজারে’। স্বামীর বাধা মানেননি হালিমা। বরং স্বামীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, নিজে ব্যবসা করে সংসারে বাড়তি আয় করতে করবেন তিনি।

এভাবেই চ্যাপা শুটকির ব্যাবসা শুরু করেন তিনি। তারপর ছোটখাট বাধা পেরিয়ে এখন সফল ব্যবসায়ী। স্বামী জয়নাল মিয়া এখন তাকে ব্যবসায় সাহায্য করেন। পাইকারি বাজার থেকে মালামাল কিনে এনে দেন জয়নালই।

‘বউ বাজারের’ ক্রেতা দুই কলোনিসহ আশপাশের নিম্ন আয়ের ক্রেতারা। তুলনামূলকভাবে এলাকার অন্যান্য বাজার থেকে এখানকার পণ্যসামগ্রী সস্তা। এ কারণেই এখানে যারা বাজার করেন, তারা পুরনো ক্রেতা।

পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে এখন আর দিনমজুরের কাজ করতে পারেন না কাউসার মিয়া। তার অসুস্থতার পর সংসারের হাল ধরেছেন স্ত্রী খোদেজা বেগম। 

খোদেজা জানান, দুই বছর আগে স্বামীর অসুস্থতার পর দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে খুবই বিপদে পড়ে যান তিনি। হাতে কোনো পুঁজি ছিল না। তবে ওই শূন্য হাতেই ব্যবসা শুরু করেন। 

মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে মাছ এনে বউ বাজারে বিক্রি করতে থাকেন। মাছ বিক্রি শেষে মহাজনের বকেয়া পরিশোধ করেন। এই আয়েই তার সংসার চলে এখন।

৩০ বছর আগে শুরু হওয়া এই বউ বাজার এখন অনেক নারীর জীবন বদলে দিয়েছে। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন তারা। 

ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি শংকর সাহার মতে, বউ বাজারটি দীর্ঘদিন আগে থেকে চলে আসছে। পরিবেশ আর একটু ভালো করা গেলে নারীদের পরিচালিত এই বাজার ঘিরে ব্যবসা আরও বাড়বে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু বলেন, বাজারটি নারীদের অগ্রযাত্রার একটি উদাহরণ। সিটি করপোরেশন বাজারের কাঠামোগত উন্নয়নে কাজ করছে। এই বউ বাজারসহ অন্য বাজারগুলোকেও আমরা আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন করে তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়