ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ও দ্রুত শেখার ৭ উপায়

লাইফস্টাইল ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:০০, ১৪ অক্টোবর ২০২১  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর উপায় সবারই কাজে লাগতে পারে। সেইসাথে যে কোনও কিছু দ্রুত শিখে নেয়ার ক্ষমতাকে যদি আরও শক্তিশালী করা যায়, তাহলে তো কথাই নেই। মানব সভ্যতা যে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে, তার অন্যতম একটি কারণ হল মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা। প্রখর স্মৃতিশক্তি, দ্রুত চিন্তা করার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, নতুন কোনও দক্ষতা দ্রুত শিখতে পারা – যে কোনও মানুষকে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে।

একজন স্বাভাবিক মানুষের শরীরের শক্তি বা সৌন্দর্য একটা বয়সের পর কমে যেতে থাকে, এবং এক সময়ে তা একেবারেই কমে যায়। কিন্তু মস্তিষ্কের ক্ষমতা শারীরিক ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী, এবং এই শক্তি ব্যবহার করে অনেক বেশি কিছু অর্জন করা যায়।

আসলে মানুষের জীবনের সাফল্যের জন্য মস্তিষ্ককে ঠিকভাবে ব্যবহার করাই সবচেয়ে জরুরী। মনে রাখতে পারা এবং প্রয়োজনের সময়ে মাথা খাটাতে পারা হতে পারে আপনার সাফল্যের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

আর এই হাতিয়ারকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা আজ আপনাকে জানাবো স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানোর ৭টি উপায়। এগুলো চর্চা করলে দিনে দিনে আপনার স্মৃতিশক্তি ও চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হবে।

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ও দ্রুত শেখার উপায় সমূহ

০১. দি থার্প মেমোরি ওয়ার্ক আউট

আমেরিকার নিউ ইয়র্কের একজন নামকরা কোরিওগ্রাফার টোয়লা থার্প স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য এই বিশেষ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন।

ট্রেনিং দেয়ার পর তিনি তাঁর পারফর্মারদের প্রথম বারের পারফর্মেন্স দেখার সময়ে কোনও নোট নিতেন না। কোনও বিষয়ে ট্রেনিং দেয়ার পর প্রথম পারফর্মেন্সে মানুষ ভুল করে।  ট্রেইনার সেই ভুলগুলো সাধারণত লিখে রাখেন, এবং পরে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। থার্প প্রথম ১২ থেকে ১৪টি ভুল লিখতেন না। এগুলো তিনি মনে রাখার চেষ্টা করতেন।

টোয়লা থার্প তাঁর বই “দি ক্রিয়েটিভ হ্যাবিট” – এ লিখেছেন যে, বেশিরভাগ মানুষ সাধারণত দুই থেকে তিনটির বেশি ভুল না লিখে মনে রাখতে পারেনা। – কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন প্রাকটিস করলে এক সময়ে গিয়ে মনে রাখার পরিমান বেড়ে যায়।

না লিখে কিছু মনে রাখার চেষ্টা করা, এবং সেইসব নিয়ে পরে আলোচনা করা স্মৃতিশক্তি ও ব্রেনের পারফর্মেন্স বাড়ানোতে দারুন ভূমিকা রাখে।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন, সবাই তো আর কোরিওগ্রাফার নয় যে মানুষকে ট্রেনিং দিয়ে তাদের ভুল গুলো মনে রাখার সুযোগ পাবে।

আসলে এই প্রাকটিস করার জন্য কোরিওগ্রাফার বা ট্রেইনার হওয়ার দরকার নেই। একটি বই পড়ে তার লাইনগুলো মনে রাখার চেষ্টা করুন, প্রতিদিন যে রাস্তা দিয়ে যান – সেই রাস্তার আশপাশের জিনিসগুলো মনে রাখার চেষ্টা করুন – এভাবেও এই প্রাকটিস করতে পারেন।

প্রথমে যদি ৩ থেকে ৫টি জিনিস মনে রাখতে পারেন, ধীরে ধীরে এই মনে রাখার পরিমান বাড়তে থাকবে। আর এই অভ্যাস করতে করতে দেখবেন, যে কোনও জিনিসই অনেক দ্রুত মনে রাখতে পারছেন।

০২. নতুন কিছু বারবার করুন

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর উপায়

একটি জিনিস বারবার করার মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরোন শক্তিশালী হয়। আপনি যখনই নতুন কিছু জানবেন বা শিখবেন – তখনই ব্রেনে একটি নতুন নিউরাল পাথওয়ে বা সংযোগ পথ তৈরী হয়। আর সেটি যখন বারবার প্রাকটিস করা হয় – তখন সেটি অনেক শক্তিশালী হয়ে যায়।  মানুষ আর সহজে সেটি ভোলে না।

ইংরেজী বিখ্যাত প্রবাদ “practice makes one perfect” আসলে এই ধারণা থেকেই এসেছে। কোনওকিছুতে পারফেক্ট হতে চাইলে আপনাকে সেটা বারবার প্রাকটিস করতে হবে। একটা কিছু মনে রাখতে চাইলে সেটা বারবার ভাবতে হবে, মনে করার চেষ্টা করতে হবে।

এই পদ্ধতিটি আপনি অন্যান্য ভালো অভ্যাস গড়ার কাজেও লাগাতে পারেন।  ধরুন আপনি সব কাজে ঢিলেমি করেন।  সময় শেষ হয়ে আসার আগে কাজে হাত দেন না।  এখন আপনি যদি দিনের একটি কাজ ঠিক সময়ে করার প্রাকটিস শুরু করেন – তবে আপনার ব্রেন ঠিক সময়ে কাজ করায় অভ্যস্ত হওয়া শুরু করবে।  সব কাজ একবারে প্রাকটিস করার দরকার নেই। শুধু একটি কাজ সময় মত করার অভ্যাস করুন।  দেখবেন, অন্য কাজগুলোও সময়মত করতে মস্তিষ্ক আপনাকে তাগাদা দিচ্ছে।

০৩. প্রতিদিন নতুন কিছু শিখুন

স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য এটা খুব কার্যকর উপায়।  আপনি মস্তিষ্ককে একটি কাজে যত বেশি ব্যবহার করবেন – সে তত বেশি শক্তিশালী হবে।  আর মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা খুব ভালো একটি উপায়।

এটার জন্য প্রতিদিন একটি নতুন শব্দ শিখতে পারেন।  সেটা হতে পারে বাংলা ভাষার নতুন শব্দ, অথবা ইংরেজী বা অন্য কোনও ভাষা।  প্রতিদিন সকালে ডিকশনারি বা ইন্টারনেট থেকে একটি নতুন শব্দের অর্থ শিখুন।  চাইলে লিখে রাখতে পারেন।  দিনে যখনই সময় পাবেন – সেটা মনে করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে দেখে নিন।  এর সাথে সাথে আগে শেখা শব্দগুলোও মনে করার চেষ্টা করুন।  এতে আপনার মস্তিষ্ক শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি একটি ভাষার দক্ষতাও বাড়তে থাকবে।

মজার ব্যাপার হল, নতুন ভাষা বা শব্দ শিখলে মস্তিষ্কের চিন্তা ভাবনার প্যাটার্ণও উন্নত হয়।  মস্তিষ্ক আসলে তার জ্ঞানের ভিত্তিতে সবকিছু বিচার করে।  যে কোনও ধরনের জ্ঞান বাড়লেই তার চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়ে যায়।  কাজেই, প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা মানে মস্তিষ্কের সামগ্রিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

০৪. গণিত চর্চা করা

গণিত চর্চা করা যে শুধু হিসাব নিকাশের দক্ষতা বৃদ্ধি করে – তাই নয়।  স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও এটি দারুন একটি মাধ্যম।  আর এর জন্য খুব জটিল অংক প্রাকটিস করারও দরকার নেই।  অবসর সময়ে ছোট ছোট পাটিগণিত বা বিজগনিত নিয়মিত প্রাকটিস করলেও মস্তিষ্কের দারুন ব্যায়াম হয়।  চাইলে আপনি এই ধরনের এ্যাপও নামিয়ে নিতে পারেন।  বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও এই ধরনের অংক এবং লজিক্যাল গেম পাবেন।  এগুলো আপনার চিন্তা ভাবনাকে পরিস্কার করবে, এবং সামগ্রিক ভাবে বুদ্ধি বাড়াবে।

০৫. ব্যায়াম ও শরীরচর্চা

ব্যায়াম ও শরীরচর্চা যে শুধু শরীরের ফিটনেসই বাড়ায় – তা নয়।  মস্তিষ্কের ফিটনেস বাড়াতেও এটা দারুন ভূমিকা রাখে।

এমনকি দিনে ২০ মিনিট শরীরচর্চা করলেও মস্তিষ্কের তথ্য প্রসেস করা ও স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা অনেকটাই বেড়ে যায়।  গবেষকদের মতে, নিয়মিত শরীরচর্চা করলে মস্তিষ্কে নিউরাল পাথ বা সংযোগ পথ অনেক দ্রুত তৈরী হয়।  মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগের গতি বেড়ে যায়।

দিনে মাত্র আধা ঘন্টার মত শরীরচর্চা আপনার মনে রাখার ও চিন্তা করার ক্ষমতা অনেকটা বাড়িয়ে দেবে।  আপনার মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাও বেড়ে যাবে, এবং মানসিক অস্থিরতা কমবে। কিছুদিন এটা প্রাকটিস করলেই বুঝতে পারবেন, আপনি আগের চেয়ে অনেক দ্রুত চিন্তা করতে পারছেন, এবং অনেক সহজে নতুন জিনিস মনে রাখতে পারছেন, পড়াশুনা ও কাজে ফোকাস বেড়ে যাচ্ছে।

আর এই শরীরচর্চা করার জন্য আপনাকে জিমে ভর্তি হতে হবে না, বা ঘরের বাইরেও যেতে হবে না। ঘরে থেকেই যদি প্রতিদিন একটা সময়ে কিছুক্ষণ জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফান, একটু বুকডন দেন, একটু হাত পা নাড়েন – তাহলেই দেখবেন বেশ কাজ হচ্ছে।

০৬. হাসিখুশি থাকুন

কথায় বলে হাসি হল সকল রোগের ওষুধ। কিন্তু এটা অনেকেই বলে না, হাসিখুশি থাকলে আপনার সার্বিক বুদ্ধি ও চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়বে।

কাজের পরের সময়টা কাছের মানুষদের সাথে কাটানোর চেষ্টা করুন। যাদের কাছে গেলে আপনার ভালো লাগে, নিজেকে সুখী মনে হয় – তেমন মানুষদের সাথে বেশি সময় কাটান।  মন ভালো থাকলে চিন্তা ভাবনা পরিস্কার থাকে, মস্তিষ্ক রিল্যাক্সড থাকে।  এটা মস্তিষ্কের কাজ ঠিকমত হওয়ার জন্য খুবই জরুরী।

কাছের মানুষদের সাথে সময় কাটানোর পাশাপাশি সময় পেলে বেড়াতে যাওয়া, বই পড়া, একটু বিনোদন করা – ইত্যাদি কাজ মনকে হাল্কা রাখার পাশাপাশি মস্তিষ্ককেও চাঙ্গা রাখে।

আপনি যতই বুদ্ধিমান হন না কেন, যদি মনকে হাল্কা রাখতে না পারেন – সেই বুদ্ধি ঠিকমত কাজে লাগাতে পারবেন না।  দেখা গেছে, যেসব ছাত্র পরীক্ষার আগে বেশি টেনশন করে – তারা পরীক্ষার সময়ে কিছু মনে করতে পারে না।  অন্যদিকে যারা হাল্কা মেজাজে থাকে, তাদের পরীক্ষা ভালো হয়।  এর কারণ হল মেজাজ ফুরফুরে থাকলে স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধি বেশি ভালো কাজ করে।  যারা সব সময়ে হাসিখুশি থাকে ও মাথা ঠান্ডা রাখে, তারা যে কোনও বিষয় দ্রুত শিখতে পারে, এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান ভাবতে পারে।

০৭. খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখুন

মস্তিষ্কের এনার্জির মূল একটি উ‌ৎস হল গ্লুকোজ।  মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে এই উপাদানটি বেশ ভালো পরিমানে থাকে।  অনেক বিশেষজ্ঞই পরিমিত মাত্রায় প্রতিদিন চকলেট খেতে বলেন।  চকলেট খাওয়ার সময়ে মস্তিষ্কে ডোপামিন উ‌ৎপন্ন হয়।  ডোপামিন মনে রাখার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে।

মিষ্টি জাতীয় খাবারের বাইরে মাছ ও সব্জী বেশি করে খাওয়ার চেষ্টা করুন।  মাংসের চেয়ে এই ধরনের খাবার গুলো মস্তিষ্কের জন্য বেশি উপকারী।

পরিশিষ্ট:

বর্তমান সময়ে তথ্যের সহজলভ্যতা আমাদের মস্তিষ্ককে দুর্বল করে দিয়েছে। মস্তিষ্ক জানে যে, কোনও তথ্য সে মনে রাখতে না পারলেও আপনি ইন্টারনেট থেকে সার্চ করে সহজেই বের করতে পারবেন। অথবা মোবাইল ডিভাসেই স্টোর করতে পারবেন। কাজেই, তার মনে রাখার দরকার নেই।  আবার, কোনও সমস্যার সমাধান ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায় – এটা আমাদের অবচেতন মনে গেঁথে গেছে। একারণে মস্তিষ্ক সমস্যার সমাধানে বেশি একটা খাটতে চায় না।

কিন্তু এই অভ্যাস এর কারণে মানুষ হিসেবে আমাদের যোগ্যতা কমে যাচ্ছে। টেকনোলজি যতই উন্নত হোক, যতই ইন্টারনেট আমাদের সাহায্য করুক, মানুষ হিসেবে যদি আপনার স্মৃতিশক্তি ও চিন্তা করার ক্ষমতা ভালো থাকে – তবে যে কোনও জায়গায়ই সাফল্য পাওয়া সহজ হবে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়