ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

মাহাত্ম্যপূর্ণ দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ১৫ অক্টোবর ২০২১  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

সনাতন ধর্মের তিনটি দিক আছে। দর্শন, পুরাণ ও অনুষ্ঠান। দর্শন হলো তত্ত্ব বা আসল রহস্য, পৌরাণিক কাহিনির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া। আর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরো মোটা দাগে বোঝানো। দুর্গাপূজার তত্ত্বই-বা কী, আর এর পৌরাণিক কাহিনিই-বা কী, তা জানার আগ্রহ আমাদের সবারই আছে। গল্পের আকারে বললে আমাদের বুঝতে সহজ হয়।

মার্কণ্ডেয় পুরাণে আছে, সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য দুর্গাপূজা করেছিলেন। সুরথ রাজাকে একবার শত্রুসৈন্যরা পরাজিত করল। তিনি নিজের রাজ্যে আছেন; কিন্তু এখানেও তার লোভী, দুষ্ট ও বলবান রাজকর্মচারীরা রাজার রাজকোষ দখল করল। সৈন্যবাহিনীরও কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। রাজা সুরথ হরিণ শিকার করবার ছলে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে বনে চলে এসেছেন। সে বনে বাঘ-সিংহ এসব হিংস পশুরাও খুব শান্তস্বভাব—হিংসা করে না। কারণ সেখানে আছে এক আশ্রম। আশ্রমে আছেন এক মুনি ও তার শিষ্যরা। সে মুনির নাম মেধস মুনি। সুরথ রাজাকে মেধস মুনি খুব সমাদর করলেন। রাজা মুনির আশ্রমে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে কাটালেন। তার মন বড় খারাপ। তার দুশ্চিন্তা হলো—তার রাজ্য পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করেছেন, আর তিনি তা পরিত্যাগ করে এসেছেন। দুষ্ট কর্মচারীরা ধর্ম অনুসারে রাজ্য পরিচালনা করছে কি না, তার প্রিয় মহাবল হস্তিবাহিনী কি ঠিকমতো খাদ্য পাচ্ছে? যেসব কর্মচারী রাজার কাছ থেকে পুরস্কার, ভোজন, বেতন ইত্যাদি পেয়ে রাজার অনুগত ছিল—তারা এখন অন্য রাজার চাকর হয়ে কত কষ্ট পাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে রাজকোষে যে ধন তিনি সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ও তার দুষ্ট কর্মচারীরা তাড়াতাড়িই শূন্য করে ফেলবে। রাজা এসব অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এমন সময় সে রাজা আশ্রমের কাছেই এক বৈশ্যকে দেখলেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন—তিনি কে? এখানে তিনি কেন এসেছেন? উত্তরে বৈশ্য জানালেন যে, তার নাম সমাধি বৈশ্য। তিনি ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। তার স্ত্রী-পুত্রগণ অসাধু। তারা তার ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। আত্মীয়-বন্ধু যারা ছিল, তারা কেউ আর জিজ্ঞাসাও করে না। তাই দুঃখিত হয়ে তার বনে চলে আসা। পরিবার পরিজন কেমন আছে—এই সব চিন্তা করে তার মন খারাপ; কিন্তু যে পরিবার পরিজন ধন কেড়ে নিয়ে তাকে পরিত্যাগ করেছে, তাদের প্রতিও বৈশ্যের কেন স্নেহের উদ্রেক হচ্ছে—এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না বৈশ্য। তার মমতা হচ্ছে কেন? কারণ তার আত্মীয়স্বজনকে তিনি শত্রু ভাবতে পারছেন না। যারা তাকে দুঃখ দিয়েছে তাদের প্রতিও মন তার আকৃষ্ট হচ্ছে। রাজা সুরথ আর বৈশ্য সমাধি দুজনে ভাবলেন, এই বনেই তো মেধস মুনির তপোবন। দুজনে মুনির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন—আমাদের মন খারাপ হচ্ছে কেন?

তখন মেধস মুনি বললেন, এর কারণ হচ্ছে মহামায়া। তিনি হয়কে নয় করতে পারেন, নয়কে হয় করতে পারেন। সব প্রাণীর বিষয়জ্ঞান আছে। খাওয়ার ব্যাপারে, ঘুমানোর ব্যাপারে পশু আর মানুষ প্রায় একই রকম। আর একটি দেখার জিনিস এই যে, পাখীরা জানে যে বাচ্চারা খেলে নিজের পেট ভরবে না, তবুও নিজেরা না খেয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবার মুখে করে নিয়ে আসে। মানুষও উপকার পাবার আশায় ‘ছেলে বড় হয়ে আমাদের দেখবে’—এই মনে করেই সন্তানের প্রতি আসক্ত হয়। এই মোহ এবং মমতাই সংসারের জাল। এই মহামায়া জগত্পতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রা। তিনি খুশি হলে মানুষকে এই মোহ ও মমতার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে পারেন। রাজা সুরথ জিগ্যেস করলেন, যাকে আপনি মহামায়া বলছেন তিনি কে? তিনি কীরূপে, কোথা থেকে উত্পন্ন হন? মেধা ঋষি বললেন, এই মহামায়া নিত্যা মানে তার উত্পত্তি নেই এবং বিনাশও নেই। এই যে জগতের যা কিছু সবই তার বিরাট শরীর। দেবগণের কার্য সিদ্ধির জন্য তিনি আবির্ভূত হন। সুতরাং মানুষ যে শোক-মোহ নিয়ে সংসারে কষ্ট পাচ্ছে, তার থেকে মুক্তি লাভ করার জন্য এই মহামায়ারই শরণ নিতে হবে। দুর্গাপূজা তাই ভগবানের সৃষ্ট দেবতার আরাধনা নয়, মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা।

দুর্গতিনাশিনী দুর্গার পূজা তাই মাহাত্ম্যপূর্ণ। দেবতা আর অসুরের সংগ্রাম। রামচন্দ্রের রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা হয়েছে। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধে জয়ের জন্য অর্জুনকে দুর্গাস্তব করতে বলেছেন। এই পূজা করেই সুরথ রাজা তার রাজ্য ফিলে পেলেন। আবার সমাধি বৈশ্য সমস্ত মোহ ও মমতার সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরম আনন্দ অনুভব করলেন, আর তার সংসারের দুঃখে জন্মগ্রহণ করতে হবে না। প্রাচীনকালে যেমন সত্য ছিল, বর্তমান কালেও তাই। বর্তমানেও মানুষ ধন-পুত্র, যশ, রূপ, জয় ইত্যাদি লাভের জন্য দুর্গাপূজা করে থাকে। ভক্তি ও মুক্তিলাভের জন্যও করে।

আমরাও দুর্গা দেবীকে প্রণাম জানাই—হে দেবী, আপনি সবার হৃদয়ে বুদ্ধিরূপে বিরাজ করেন। আপনিই স্বর্গ বা ভোগ এবং অপবর্গ বা মুক্তিদায়িনী নারায়ণী। আপনাকে প্রণাম। আজ বিজয়া দশমী। সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছা।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়