ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

মহিমান্বিত হজ: ইসলামের সবচেয়ে বিস্ময়কর ইবাদত

শরীফ আব্দুল্লাহ

প্রকাশিত: ১৭:১৩, ৩ জুলাই ২০২২  

হজকে ইসলামের সবচেয়ে বিস্ময়কর ইবাদত বলা হয়ে থাকে। অন্য অনেক ইবাদতের মতো এই ইবাদতটি একাকি করা সম্ভব নয়। এখানে আল্লাহর অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একইসঙ্গে ইবাদতের ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয়।

সাহস করে একথা বলাই যায় যে, শুধু ইসলাম নয় বিশ্বে প্রচলিত অন্য কোনো ধর্মে এত বিশাল ইবাদতের অনুষ্ঠান আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলিমরা জমায়েত হওয়ার মাধ্যমে তাদের অন্তরের ঘনিষ্ঠতা শক্তিশালী করেন।

মুসলিম উম্মাহর নিকট জাতীয় পর্যায়ে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের দিক নির্দেশনায় হজ মৌলিক ভূমিকা রাখে। বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে উদ্বুদ্ধ করে। একতার বন্ধনে প্রভুপ্রেমে নত হতে উৎসাহ দিয়ে যায় হজের বিধান। পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতির লক্ষ্যে সব ধর্মেই কিছু আচার-অনুষ্ঠান আছে। যেখানে এসে নিজেরা সম্পর্ক রক্ষা করে চলে।

কিন্তু ইসলাম ধর্মে প্রেমময় হজের সঙ্গে অন্যকোনো ধর্মের তুলনা হয় না। সাদা কাপড় পড়িহিত এতো আশেকানের বিশাল জমায়েত! কোন প্রচারণা ছাড়াই লাখ লাখ হাজি প্রতিবছর একই জায়গায় সমবেত হোন কোন মহিমায়। কিসের টানে ওই মরুর পানে মহান যাত্রার বিশাল মিছিল? বিভিন্ন দেশের নানা ভাষা ও বর্ণের মানুষ অভিন্ন চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে মক্কা ভূমিতে হাজির হয়। ঐ কাবার চারপাশের নূর ফোয়ারায় অবগাহন করতে প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের তামান্না ব্যাকুল হয়ে থাকে। কেনো সেই অতুলস্পর্শী গহীন হৃদয়ের আকুলতা? কিভাবে তৈরী হলো সবার হৃদয়-মিনারে প্রত্যাশার ব্যাকুল ব্যাঞ্জনা? 

পবিত্র কোরআনের বর্ণনা দ্বারা উপলব্ধি করা যায়, ঐশী নির্দেশনায় ইবরাহিম (আ.) কাবা ঘর নির্মাণের পর আল্লাহর কাছে আরজি পেশ করলেন, হে আল্লাহ! এই নির্জন মরু প্রান্তরেকে এই ঘর তাওয়াফ করতে আসবে। তখন আল্লাহ তায়ালা আদেশ করলেন, তুমি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর দূরান্ত থেকে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে পারে এবং তার দেওয়া চতুস্পদ জন্তু সমূহ জবাহ করার সময় নির্দিষ্ট দিন গুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। (হজ : ২৭-২৮)

হজ মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের অনুপম নিদর্শন। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ঐক্যের বিরল সেতুবন্ধন। রাসুলে কারিম (সা.) এর হাদিসে মুমিনদের এক দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। হজের ইবাদতের মধ্যেই এক দেহ এক প্রাণের চোখশীতল করা সেই অভাবনীয় দৃশ্য ফুটে ওঠে আপন মহিমাময়। হজের ইহরাম, তালবিয়া- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক থেকে শুরু করে সর্বশেষ বিদায়ি তাওয়াফ পর্যন্ত একই ব্যাঞ্জনা ধ্বনিত হয়।

পবিত্র কাবার তাওয়াফ, সাফা মারওয়ায় সায়ি, আরাফায় অবস্থান, মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ ও তাওয়াফে জিয়ারত সহ হজের সকল বিধানাবলীর মধ্যে ঐক্যের সুবাস ছড়িয়ে আছে। তাই তো, আরাফার ময়দানে একই ইমামের পেছনে সবাই নামাজ পড়েন। মুসলিম উম্মাহর দিক নির্দেশনামূলক খুতবা প্রদান করে খতিব সাহেব। ব্যক্তি জীবন থেকে জাতীয় জীবনে কী করণীয়; বিস্তর আলোচনা করেন।

হজ পালনে নেই কোনো ভেদাভেদ। একই স্থানে ধনী-গরিব, রাজা-প্রজার অবস্থান। শুভ্র বসনে লাখো হাজির দিল জুড়ানো দৃশ্যের অবতারণা। এখানেই ইসলামের সমতার মর্মবাণী সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।

ইসলামের সব বিধান সংঘবদ্ধভাবে পালনের প্রতি গুরুত্ব এসেছে। যেমন, নামাজে জামাতের সাথে আদায়ের তাগিদ করা হয়েছে। রোজা রাখার পর এক সাথে অন্যকে নিয়ে ইফতার করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কয়েকজন সফরে বের হলে একজনকে আমির বানানোর নির্দেশ হাদিস শরীফে এসেছে। তেমনিভাবে হজের মতো মৌলিক ইবাদতও এক সাথে আদায় করতে হয়।

মোটকথা, ইসলামের সকল বিধানের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার চিত্র ফুটে ওঠেছে। তাই, ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের বিধানাবলী পালনের মধ্যে আলাদা তাৎপর্য বহন করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামি শরীয়ত একটি বিশেষ বার্তা দিতে চায়। আর তা হলো, সামগ্রিক জীবন পরিচালনায় মুসলিম উম্মাহকে একতাবদ্ধভাবে চলতে হবে।
 
পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে নববির বর্ণানায় বারবার মুসলমানদের ভাই ভাই হয়ে সংঘবদ্ধভাবে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। হাদিস শরীফে গোটা মুসলিম উম্মাহকে এক দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকার পাশাপাশি বিভেদ থেকে দূরে থাকার জন্য জোরালো নির্দেশ প্রদান করেছে কোরআনে কারিম। ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।' ( আল ইমরান : ১০৩)

আর সেই ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সূতীকাগার হিসাবে পবিত্র বাইতুল্লাহকে নির্ধারণ করেছেন মহান রাব্বুল আলামীন। ইরশাদ হচ্ছে, 'মানুষের জন্য জন্য প্রথম ঘর নির্মাণ করা হয়েছে বাক্কায় (মক্কাতে)। যা সমগ্র বিশ্ব বাসীর জন্য কল্যাণের আধার ও হেদায়েতের আলোকবর্তীকা হিসাবে চির সমুজ্জল হয়ে আছে।' (আল ইমরান : ৯৬)

বাইতুল্লাহর হজ সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধনের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। হজ উপলক্ষে বিশ্বের মুসলমানদের যে মিলনমেলা ঘটে তাতে 'এক দেহ এক প্রাণ' এর বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। প্রভুপ্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রেমিক প্রেমাস্পদের মোহনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয় পবিত্র কাবার মাঝে, যার নজির পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম বা জাতীগোষ্ঠী দেখাতে পারবে না। খোদাপ্রদত্ত সকল বিধানের মধ্যে মুসলমানদের একতার সেতুবন্ধনে আবদ্ধ রেখেছেন। অনুপম ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দিয়েছেন। পরস্পর শ্রদ্ধা, ভালোবসা ও সমতার রক্ষা করে ঐক্যবদ্ধতার পথে চলতে উৎসাহী করেছে ইসলামী শরীয়ত। বিশেষত হজের মধ্যে আমরা সেই বাস্তব চিত্র লক্ষ করতে পারি। বিদায় হজের ভাষণেও রাসুল (সা.) ঐক্যবদ্ধ থাকার শিক্ষা দিয়েছেন।

বর্তমান বিশ্বে ইসলাম যখন চরম হুমখির সম্মুুখিন। শতোধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ যখন অস্তিত্বের সংকটে ভোগছে তখন হজের শিক্ষা আমাদের মধ্যে বাস্তবায়ন করে জাতীয় জীবনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। কারণ, হজ এমন একটি ইবাদত যাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মুসলমানরা একই সময়ে একই জায়গা সমবেত হোন।

মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ইবাদত- হজের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করা। প্রতি বছর হজের মৌসুমে সারাবিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান সব ধরনের জাতিগত ও ভৌগোলিক ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে হজের আনুষ্ঠানিক ইবাদত সম্পন্ন করার মাধ্যমে একদিকে আল্লাহর বিধান পালন করেন এবং অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ শক্তিশালী করেন।হজকে ইসলামের সবচেয়ে বিস্ময়কর ইবাদত বলা হয়ে থাকে। অন্য অনেক ইবাদতের মতো এই ইবাদতটি একাকি করা সম্ভব নয়। এখানে আল্লাহর অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একইসঙ্গে ইবাদতের ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয়।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়