বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছোটবেলার মধুর স্মৃতি
আলহাজ্জ এ কে এম রফিকুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালি জাতি তাঁকে নিয়ে গর্ব বোধ করে। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে একটি দেশ ও একটি জাতি গঠিত হয়েছে। তিনি বিশ্বনেতা। বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও স্বাধীনতাকামী জনতার প্রতিনিধি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ তিনি সব সময় নির্যাতিতের পক্ষে কাজ করেছেন। কোনো কিছুর জন্যই তিনি নিজের ও দেশের সম্মান নষ্ট হতে দেননি। যা কিছু অর্জন করেছেন, তা দৃঢ় মনোভাব, প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণে। একজন রাজনৈতিক নেতার সবচেয়ে বড় গুণ হলো মানুষকে আপন করার শক্তি। সেই শক্তিগুণে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চরম শত্রুকেও আপন করে নিয়েছেন, সহানুভূতি দিয়ে সংশোধনের পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ছিলেন নিরহংকারী। ইতিহাস এই মানুষটিকে ভিন্নতা দিয়েছে তাঁর স্পষ্টবাদিতার জন্য। ত্যাগ, ন্যায্যতা, সততা, সহমর্মিতা, ভালোবাসার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়ে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত ছিল তাঁর। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর সাধনা ছিল শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। এ জন্য তিনি মানবিকতা ও ভালোবাসাকে সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের মন জয় করা ছাড়া সামগ্রিক কল্যাণ সাধন একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। সেই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ। গোপালগঞ্জে এই ক্ষণজন্মা মহাপরুষ জন্মগ্রহণ করায় আমরা গোপালগঞ্জবাসী ধন্য ও গর্বিত। আমার ছোটবেলার একটি স্মরণীয় ঘটনা এখানে বর্ণনা করছি—
আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার কাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুর মানিকহার গ্রামে। আমার বাবা ডাক্তার এবং চাচা ব্রিটিশ আমল থেকে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকায় আমরা এলাকায় খুব সুখ্যাতি ও শান্তির সঙ্গে বসবাস করতাম। বর্ষাকালে আমাদের গ্রাম পানিতে ডুবে যায় বলে বাড়িগুলো ছিল উঁচু টিলার মতো। ১৯৫৩ সালের শেষ অথবা ১৯৫৪ সালের প্রথম দিকের ঘটনা, যখন আমি সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, তখন হাফপ্যান্ট পরতাম। আমার খেলার ছোট বলটি বাড়ির নিচে গড়িয়ে পড়লে সেটির খোঁজ করছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন আমার পিঠে হাত রেখে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘ভাইটি কেমন আছ?’ আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি লম্বা, শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের এক যুবক। তাঁর সঙ্গে থাকা আরেক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব কি বাড়ি আছেন?’ আমি তাঁদের সালাম জানিয়ে বললাম, তিনি বাড়ি আছেন। তাঁদের বৈঠকখানায় বসতে দিয়ে চাচাকে ডেকে আনলাম। আমিও পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের কথাবার্তা শুনতে থাকলাম। লক্ষ করলাম, লম্বা ও ছিপছিপে গড়নের লোকটি যুক্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ কণ্ঠে চাচার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই দিন থেকে জানতে পারি বলিষ্ঠ কণ্ঠটি শেখ মুজিবুর রহমানের এবং তিনি বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের কালজয়ী নেতা। সেই সময় থেকে তাঁর স্নেহমাখা ব্যবহার ও যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে তাঁর ভক্ত হয়ে যাই। সুযোগ পেলেই তাঁকে জানা এবং তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতি পরম আগ্রহে শুনতে থাকি। উল্লেখ্য, আমার চাচা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকায় জনাব ওয়াহিদুজ্জামান (পাকিস্তানের সাবেক কমার্স মিনিস্টার), সাবেক এমপি জনাব ফায়েকুজ্জামান, অ্যাডভোকেট আ. ছালাম খান প্রমুখ প্রায়ই, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো যুক্তিপূর্ণ, বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও জাতীয়তাবাদ দিয়ে কেউই আমাকে মুগ্ধ করতে পারেননি।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় এবং প্রতিবছর বন্যায় ফসল ধ্বংস হওয়ায় আমাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। সে কারণে ১৯৬৩ সালে বিএসসি পাস করার পর তিন বছর সহকারী হেডমাস্টার কাম বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন (বালিয়াভাঙ্গা) ও মেরী গোপীনাথপুর হাই স্কুলে শিক্ষকতা করি। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির এক্সপ্লোসিভস ফ্যাক্টরিতে প্রডাকশন কেমিস্ট হিসেবে কাজ করায় তখন আমার পক্ষে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করা সম্ভব ছিল না।
১৯৭০ সালের শেষভাগে বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে বদলি হয়ে আসি। এসেই জানিতে পারি গাজীপুর ইউনিয়নে আ ক ম মোজাম্মেল হক (বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আদর্শ ও চেতনার কারণেই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মোজাম্মেল সাহেবকে ভোট দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। সেবার মোজাম্মেল সাহেব বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। শুরু হয় আন্দোলন, যা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে রূপ নেয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে মিটিং-মিছিল করতাম। সেসব মিটিংয়ে আমাদের শ্রমিক নেতারা, বিশেষ করে আ. ছালাম, সেকেন্দার আলী, নজরুল ইসলাম, আ. সাত্তার প্রমুখ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। অন্যদিকে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির জনাব মোতালেবের (পরবর্তী সময়ে সিলেটের এমপি ছিলেন) নেতৃত্বে মিটিং-মিছিল ও আন্দোলন চলতে থাকে। সেই সময়ে গাজীপুরের স্থানীয় মানুষ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির আন্দোলনে সহযোগিতা করত। আন্দোলনের দিক থেকে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ছিল এক নম্বরে। তারাই পাকিস্তানি অফিসার মারার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা দ্বিতীয় স্থানে থেকে সর্বদা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির নেতাদের সহযোগিতা করতেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় এবং স্বাধীনতার পরে কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় কারখানার সব কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই রাজনীতি স্থানীয় লোকের হাতে চলে যায়। ফলে স্থানীয় মানুষ আন্দোলনের কৃতিত্ব পেয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাজীপুর থেকে গোপালগঞ্জে চলে আসি এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
গত জাতীয় নির্বাচনের পরে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে যাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী, আজকের বিশ্বনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বুঝতে পারি, তিনি কত বড় মনের ও বড় মাপের মানুষ। তাঁর সাবলীল কথাবার্তা ও আন্তরিকতা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। তাঁর ভালো ব্যবহার ও কথাবার্তায় মনে হয়েছিল, তিনি কত আপন, আন্তরিক ও পূর্বপরিচিত। অথচ এটা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম সাক্ষাৎ। তাঁর ব্যবহার ও কথাবার্তায় ছোটবেলার বঙ্গবন্ধুর সেই স্নেহমাখা অম্লান কথাটি ‘ভাইটি কেমন আছ?’ মনে পড়ে যায়। সেই মধুর স্মৃতি কখনো ভোলার নয়।
- ৭ শতাধিক রোগীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিলো সেনাবাহিনী
- বঙ্গবন্ধুর সাথে ছোট বেলার স্মরণীয় মধুর স্মৃতি
- ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস আজ
- পর্যটন বিকাশে চালু হচ্ছে হোম স্টে সার্ভিস
- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি যে কারণে কৃতজ্ঞ সেনাবাহিনী
- করোনা চিকিৎসায় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা
- আরো ২৪ ট্রেন চালু হচ্ছে ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে
- অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়লো সাময়িক এনআইডির মেয়াদ
- প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে উদযাপন হবে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস
- করোনা নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় আসছেন ৪ চীনা বিশেষজ্ঞ