ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

জ্বালানি নিরাপত্তায় আশার আলো রুপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৩৪, ২৪ নভেম্বর ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন মাধ্যমগুলোর একটি হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎ। পৃথিবীতে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে। বর্তমানে ৩১টি দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তির আর্থিক, কারিগরি ও পরিবেশগত সুবিধাদির বিষয়টি বিবেচনায় এ প্রযুক্তি ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা আজ সর্বজনবিদিত। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যয়বহুল জ্বালানি পণ্য যেমন- তেল, গ্যাস, কয়লার  মতো পণ্যগুলো আমদানিতে নির্ভরতা হ্রাস করে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। একটি উদহারণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি হচ্ছে ইউরেনিয়াম।

দেখা গেছে যে, ৪৫০০ টন উচ্চ গ্রেডের কয়লা থেকে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়, সেই একই পরিমাণ শক্তি মাত্র ১ কেজি ইউরেনিয়াম থেকে পাওয়া যায়। তাহলে ইউরেনিয়াম এবং কয়লার বাজার মূল্যের সঙ্গে হিসেব করে দেখুন পার্থক্যটা কী পরিমাণ আকাশ-পাতাল। যদিও প্রাথমিক খরচ অর্থাৎ প্লান্ট স্থাপন খরচ অনেক বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি একটি সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে সারাবিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত। আর এজন্যই পৃথিবীর সব উন্নত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম এটি।পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় ফ্রান্স, তৃতীয় জাপান, চতুর্থ চীন, পঞ্চম রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ষষ্ঠতম এবং ইন্ডিয়া সপ্তম। এমনকি পাকিস্তানের  মতো দেশও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। গত বছরও ১১০০ মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক পাওয়ার প্লান্ট উৎপাদন শুরু করেছে পাকিস্তান। পৃথিবীর দেশে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। নতুন নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে জাপান, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বহু দেশ। এ প্রযুক্তি যথাযথ ব্যবহার করে একটি অনুন্নত দেশ যে কত দ্রুত উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারে দক্ষিণ কোরিয়া তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ যেমন- ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। আগামী বিশ বছরের মধ্যে সৌদি আরবে ১৬টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের নাইজিরিয়া ও কেনিয়া, ইউরোপের তুরস্ক, বেলারুশ, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশসমূহ প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নতুন প্রজন্মের পারমাণবিক প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত ও নিরাপদ এবং এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম পদ্ধতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বর্তমানে পৃথিবীর ৩১টি দেশে ৪৫০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই নির্মাণ করা হবে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশসমূহে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

পূর্বপাকিস্তানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় পরমাণু বিশ্বে আবির্ভাব চিন্তাভাবনার প্রথমদিকেই সেই ১৯৬১ সালে। সেই লক্ষ্যে পাবনা জেলার রূপপুরে প্রকল্প এলাকা নির্ধারণ করা হয় এবং কাজ অনেকদূর এগিয়েও নেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের অনেক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৬৩-৬৯ সালে প্রকল্পটি অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও অনিবার্য কারণে এতদসংক্রান্ত কর্মকা- বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে নানা রাজনৈতিক অভিঘাতে এমন একটি প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৯৭-২০০০ সময়কালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম.এ ওয়াজেদ মিয়া কর্তৃক ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হলে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলি ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১০ সালের নভেম্বরে জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং রাশিয়ান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এ প্রকল্পের কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব পরমাণু ক্লাব’ (নিউক্লিয়ার নেশন)-এ যুক্ত হয়। বাংলাদেশ হবে এই ক্লাবের ৩২তম দেশ।

এক একটি ১২০০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটের ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুুুুুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় হবে ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যার নব্বই ভাগ ৪ শতাংশ সুদে রাশিয়ান ফেডারেশন ঋণ হিসাবে দিচ্ছে। বাকি দশ শতাংশ বাংলাদেশ অর্থায়ন করছে। গর্বের পদ্মা সেতুর তিনগুণের বেশি বাজেটের এ প্রকল্প বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আশা করছেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের প্রথমদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে রাশিয়ান ঋণ ও প্রযুক্তি সহায়তায় নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত প্রথম ইউনিটের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষ হয়েছে ৪৮ শতাংশ। আর পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৫৫ শতাংশ। সামনের বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রথম চুল্লির জন্য জ্বালানি পাওয়ার আশা করছেন কর্মকর্তারা। সেই বছরের অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর কথা ভাবা হচ্ছে। 

করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর তাবৎ হিসাবে গরমিল হয়ে গেছে। বিদেশনির্ভর প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও কিছুটা সমস্যা হবে সেটিই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশ সব সমস্যা কাটিয়ে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হলেও জ্বালানি নিরাপত্তার এক নতুন আশা নিয়ে আবির্ভূত হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেই আশা জাগিয়ে রাখাই যায়।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়