ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গোশত ও রক্ত নয়, আল্লাহভীতিই পৌঁছে

ইসলাম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৫৯, ৪ জুলাই ২০২২  

আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহে দুটি আজীমুশ্বান এবাদত অর্থাৎ রমজানের রোজা পালন ও হজ্জ সম্পাদন যখন হয়ে যায়, তখন একজন মুসলমান হিসেবে জরুরি হয়ে পড়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাঁর দরবারে কিছু নজরানা পেশ করার, যেই নজরানার নাম কোরবানি। সুতরাং আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের ভেতরে তার দরবারে নজরানা পেশ করাই হলো কোরবানি। এ তো রব্বুল আলামীনেরই মেহেরবানী যে, তিনি দু’দুটি আজীমুশ্বান এবাদত করার তৌফিক দিয়েছেন। লক্ষ্য করুন, মাহে রমজান পরিসমাপ্তির পর আসে ঈদুল ফিতর, আর হজ সম্পন্ন করার পরে আগমন ঘটে ঈদুল আজহার। ঈদুল ফিতরের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতে হয় সদকায়ে ফেতরের মাধ্যমে, আর ঈদুল আজহার আনন্দ উদযাপন করতে হয় কোরবানির মাধ্যমে।

কোরবানি শব্দটি আরবি। এর সমর্থক শব্দ উদ্হিয়্যাহ্। আভিধানিক অর্থ—ত্যাগ, উৎসর্গ ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায়, জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্যলাভের জন্য যে পশু জবেহ করা হয়, তাকে কোরবানি বলে।

স্বাধীন, বালেগ, বিত্তবান তথা মালেকে নেসাব, মুকীম, মুসলমানের পক্ষে তার নিজের কোরবানি করা ওয়াজিব। (হেদায়া) সুতরাং কোরবানির নেসাব যাকাতের নেসাবের মতো নয় বরং সদকায়ে ফেতরার নেসাবের সাথে সামঞ্জস্যশীল অর্থাৎ যাকাতের ক্ষেত্রে নেসাব-পরিমাণ মাল মালিকের কাছে একবছর থাকা শর্ত কিন্তু কোরবানির ক্ষেত্রে নেসাব পরিমাণ মাল মালিকের কাছে একবছর থাকা শর্ত নয় বরং সদকায়ে ফেতরের মতো নেছাব পরিমাণ মাল জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের যে কোনোদিন মালিক হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। (শামী-পৃ. ১৯৮)

কোরবানির মহত্ব, গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন তাফসির ও হাদিস-গ্রন্থে বিস্তারিত আলাচনা করা হয়েছে। কোরবানির মহত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান:

لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنكُمْ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰى مَا هَدىٰكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ ـ

অর্থাৎ ‘কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং কোরবানির মধ্য দিয়ে তোমাদের তাকওয়া-পরহেজগারী বা আল্লাহভীতিই তাঁর কাছে পৌঁছে। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন—যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা কর। এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।’ (সুরা হজ: ৩৯)

তারই আলোকে সংক্ষেপে কিছু ফজিলত ও গুরুত্বের কথা তুলে ধরছি। ইবনে মাজাহ, আহমদ ও মেশকাত শরীফে বর্ণিত আছে—

عَنْ زَيْدِ بْنِ اَرْقَمَ  قَالَ قَالَ اَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ مَا هٰذِهِ الْاَضَاحِىُّ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ سُنَّةُ اَبِيْكُمْ اِبْرَاهِيْمَ قَالُوْا فَمَالَنَا فِيْهَا يَارَسُوْلَ اللهِ قَالَ لِكُلِّ شَعْرَةٍ حَسَنَةٌـ قَالُوْا فَالصُّوْفُ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ بِكُلِّ شَعْرَةٍ مِّنَ الصُّوْفِ حَسَنَةٌـ

অর্থাৎ ‘হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই কোরবানি কি?’ তদুত্তরে হুজুর বললেন, ‘তোমাদের (জাতির) পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সুন্নত।’ পুনরায় সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের জন্য কোরবানির মধ্যে কী রয়েছে?’ হুজুর এরশাদ করেছেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতি পশমে এক-একটি নেকি মিলবে।’ তখন সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কি দুম্বা এবং ভেড়ার প্রতি-পশমের বিনিময়ে ছওয়াব মিলবে?’ হুজুর এরশাদ করলেন, ‘দুম্বা ও ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও ছওয়াব মিলবে।’

তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত হয়েছে—

عَنْ عَآئِشَةَ رَضِىْ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَاعَمِلَ ابْنُ اَدَمَ مِنْ عَمَلِ يَوْمِ النَّحَرِ اَحَبُّ اِلىَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ اِهْرَاقِ الدَّمِ واِنَّهُ لَيَاْتِىْ يَوْمَ الْقَيَامَةِ بِقُرُوْنِهَا وَاَشْعَارِهَا وَاَظْلَافِهَا وَاِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنْ اللهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ اَنْ يَقَعَ بِالْاَرْضِ فَطِيْبُوْا بِهَا نَفْسًا (روه ابن ماجه)

অর্থাৎ ‘হজরত আয়েশা থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলে করীম (সা.) বলেছেন, আদম সন্তান কোরবানির দিন যেসব নেকির কাজ করে থাকেন তার মধ্যে আল্লাহ পাকের কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি করা। কাল কেয়ামতে কোরবানির পশু তার শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে (যা কোরবানিদাতার পাল্লায় দেওয়া হবে যাতে নেকির পাল্লা ভারী হয়ে যায়)। কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পরার আগেই তা আল্লাহ পাকের কাছে কবুল হয়ে যায়। অতএব তোমরা এই পুরস্কারে আন্তরিকভাবে খুশি হও।

উল্লেখিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত এবং ইসলাম ধর্মের একটি বড় নিদর্শন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় নবী হজরত ইব্রাহীমের স্মৃতি রক্ষা করা এবং আল্লাহ পাকের রেযামন্দি লাভ করা।

একদিকে যেমন কোরবানিদাতার জন্য রয়েছে বহু প্রতিদান ও খোশখবরি, অপরদিকে সক্ষম ব্যক্তির পক্ষে কোরবানি না-করা বা অবহেলা করার জন্যও রয়েছে সতর্কবাণী। যেমন- ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত হয়েছে:

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ  اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ مَنْ كَانَ لَهٗ سَعَة ٌوَلَمْ يُضَحِّ فَلَا يَقْرُبَنَّ مُصَلَّانَاـ

অর্থাৎ ‘হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলে করীম (সা.) এরশাদ করেন, যার কোরবানি করার ক্ষমতা আছে অথচ সে কোরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’

পরিশেষে মহান আল্লাহ পাকের কাছে ফরিয়াদ, কোরআন পাকের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা যেন কোরবানির ফজিলত ও গুরুত্ব অনুধাবন পূর্বক আমল করতে পারি এবং ত্যাগের মহিমায় আমাদের জীবন রঙিন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন!

লেখক: অধ্যক্ষ, ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা ও খতিব, ঝালকাঠি কেন্দ্রীয় ঈদগাহ জামে মসজিদ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়