ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করোনায় বদলে যাওয়া পারিবারিক সম্পর্ক

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:২০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মহামারি করোনাভাইরাস আক্রান্ত সারাবিশ্ব। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাসের পর মাস বিশ্বের অনেক দেশই লকডাউনে ছিল। লকডাউনের ফলে মানুষের জীবনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। কেউ হারিয়েছে পরিজন, কারো ভেঙেছে সংসার, কেউ বা নতুন করে বেঁধেছেন ঘর।  চলুন তবে জেনে নেয়া যাক করোনাকালে মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে কিছু কথা-   
করোনাকালে নতুন সংসার: 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন থাকায় ছিল বিয়েতেও নিষেধাজ্ঞা।  অনেকেই করোনার জন্য পিছিয়ে দেন বিয়ে।  আবার কেউ কেউ ঘরোয়া পরিবেশেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন। আবার যারা পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তারাও লকডাউন সীমিত আকারে পরিবারবর্গ নিয়ে বিয়ের পর্ব সেরে ফেলেছেন।

লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই ঘরোয়াভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা সিজন নামের এক নারী সাংবাদিক।  তবে বিয়েতে তেমন কাউকে নিমন্ত্রণ করতে পারেননি। কারণ এই সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধু নিকটাত্মীয়দের নিয়ে স্বল্প পরিসরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছে। মহামারি শেষে জাকজমকতা পালন করবো। শুধু তিনিই নন বরং আরো অনেকেই মহামারির মাঝে স্বল্প পরিসরে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন।

দাম্পত্যে সুসম্পর্ক:

বাস্তবতা কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর। বর্তমান সময় সম্পর্কে বলতে গেলে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর নেই। যদি একই পরিবারে কর্মজীবী দম্পতি থাকেন তবে তাদের শুধু রাতেই দেখা হয়।  আবার সকাল হতেই যে যার কর্মস্থলে। তবে দীর্ঘ লকডাউনে বেশিরভাগ কর্মজীবীরাই হোম অফিস করেছেন। এতে করে যেসব দম্পতিদের মধ্যে সামান্য মনোমালিন্য বা অভিমান ছিল, তা সহজেই ভেঙে গেছে। 

এই কঠিন সময়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোর জন্য অনেক ছাড় দিতে হয়েছে। পুরুষরা শিখেছেন তাদের স্ত্রীরা ঘরের কাজে কতটা সময় ব্যয় করেন। কীভাবে সন্তানদের লাল-পালন করেন। সব দম্পতিরাই এই কঠিন সময়ে একসঙ্গে থেকে ভালো সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন। জীবনসঙ্গীর সঙ্গে অনেক সময় কাটানোর কারণে একে অপরে আরো কাছাকাছি এসেছেন অনেকেই। লকডাউন আমাদের দেখিয়েছে যে কোনো দম্পতি যখন একসঙ্গে সময় কাটায় তখন তাদের একে অপরের সঙ্গে কতটা সুন্দর বন্ধন হতে পারে।

ভাঙা সম্পর্কে জোড়া:

করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালে সুরক্ষার কারণে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। আর দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি জীবন কাটাতে গিয়ে অনেকেই পারিবারিক কলহে জড়িয়েছেন আবার কারো ভাঙা সম্পর্কে জোড়া লেগেছে। বলিউড তারকা ঋত্বিক রোশন আর স্ত্রী সুসান খানের প্রায় ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক এই লকডাউনের সূত্র ধরে আবার নতুন করে জোড়া লেগেছে বলে জানা গেছে।

পারিবিারিক কলহ

ঠিক একইভাবে অনেক সন্তানের সঙ্গে তাদের বাবা-মায়ের সম্পর্কের দুরত্ব ঘুঁচেছে এই লকডাউনে। আবার কেউ পরিবার নিয়ে বসবাস করার বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য রপ্ত করেছেন। কীভাবে বিপদকালীন সময়ে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হয় সেটা শিখেছেন অনেকে। এছাড়াও, অনেক বাবা-মা যারা সন্তানদেরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না, তারাও এই করোনাকালে নিজ সন্তানদের পাশে থেকেছেন। এতে খুশী শিশুরাও।  

করোনাকালে দাম্পত্য কলহ ও বিচ্ছেদ:

ঝগড়া করেন না এমন দম্পতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে লকডাউনের ফলে দাম্পত্য কলহের হার দিন দিন বাড়ছে। হিসাব বলছে, শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বে স্বামী-স্ত্রীর কলহে প্রতি সেকেন্ডেই ভাঙছে সংসার।  মাসে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ৮৪৩টিরও বেশি পরিবার। এর মধ্যে বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। হিসাব অনুযায়ী, তালাক নোটিশ প্রেরণকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। 

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাস্তবে বিয়ে বিচ্ছেদের হার আরো বেশি। কারণ অনেক মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবীসহ অনেক পরিবার রয়েছেন যাদের বিচ্ছেদ পারিবারিক সালিশের মাধ্যমে ঘটে থাকে। যার হিসেব নেই সিটি কর্পোরেশনেও। গবেষকেরা বলছেন, বাধ্যতামূলক নৈকট্যের কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ ও উত্তেজনা বেড়ে গেছে। তাই কোভিড-১৯ সংকটের পরে বিয়ে-বিচ্ছেদ বৃদ্ধির একমাত্র কারণ হবে বাধ্যতামূলক ঘরবন্দি জীবন। 

পারিবারিক অশান্তিতে ইন্টারনেটের প্রভাব:

লকডাউনে পারিবারিক অশান্তিও সৃষ্টি হচ্ছে। এ সময় পারিবারিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে ইন্টারনেট। যার জন্য ভেঙে যাচ্ছে সংসারও। একটি ঘটনার আলোকে উদাহরণ দেয়া হলো, কোয়ারান্টাইনে থাকা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও, স্ত্রী তা পাত্তা না দিয়ে বেশিরভাগ সময় ফেসবুক নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে স্বামী বাসা থেকে অফিসের কাজ করার পাশাপাশি স্ত্রীকে খেয়াল করছিলেন।

এক সময় তিনি ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে স্ত্রীকে অ্যাড করে নেন। কৌশলে ফেসবুকে অন্য মানুষ সেজে স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমালাপ শুরু করেন। একদিন ফেসবুকে স্ত্রীর কাছে তার স্বামী সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে স্ত্রী জানান, পাঁচ বছর আগেই তার স্বামী মারা গেছেন। এরপর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এমন নানা কারণে লকডাউনে অনেকের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে।

গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের সংখ্যাও বাড়ন্ত:

লকডাউনের কারণে দেশের পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবায় ব্যাঘাত ঘটেছে। লকডাউনের জেরে বৃহত্তর বেসরকারি ক্ষেত্রের পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবায় প্রভাব পড়ার কারণে গর্ভনিরোধের হার ১৫ থেকে ২৩ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে একটি মূল্যায়নে উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতে লকডাউন শুরু হয়েছে মার্চ মাস থেকে। সেই অঙ্ক ধরে এগোলে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে শিশু জন্মের হার অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে সদ্য গর্ভধারণ করে চেকআপ করাতে আসা রোগীর অঙ্ক সেই ধারণাকে আরো মজবুত করছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী পাওয়ার কথা, তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, কখনো তিন গুণ রোগী মিলছে।   

এ ব্যাপারে মনোবিদ অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, হাতে এখন অকুণ্ঠ সময়, অফিসের টেনশন কম, ক্লান্তিও কম। মানুষের বাড়িতে থাকার সময় বেড়েছে। এই হিসেবে ভর করেও এক শ্রেণির মধ্যে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার বাসনা বেড়েছে। যার ফলে গর্ভধারণের সংখ্যা বাড়ছে।গবেষণা অনুযায়ী জানা যায়, এর ফলে ২৩ লাখ ৮০ হাজার অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ, ছয় লাখ ৭৯ হাজার ৮৬৪ জন শিশুর জন্ম, আট লাখ ৩৪ হাজার ৪২টি অসুরক্ষিত গর্ভপাত-সহ মোট ১৪ লাখ ৫০ হাজার গর্ভপাত এবং এক হাজার ৭৪৩টি প্রসবকালীন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়