ছোটগল্প: সোনার পাথরবাটি (২য় পর্ব)

অনলাইন ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০১:০৩ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০২২ সোমবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

একসময়ের টানাপোড়েনের সংসার সামলে নিতে নেবুলা হিমসিম খেয়েছে। তবু নিজের সন্তানদের সাথে স্বামীর আগের স্ত্রী’র সন্তানকেও সমান স্নেহে নেবুলা যত্ন করেছে। যে কিনা, তার নিজের থেকে মাত্র দশ বছরের ছোট।

তাতে অবশ্য নেবুলার কোনো দু:খ নেই। কিন্তু নেবুলাকে না জানিয়ে তার স্বামী বড় ছেলেকে আলাদা করে সম্পত্তির একটি অংশ লিখে দিয়ে গেছেন! সেই থেকে নেবুলার ক্ষোভ। কারণ নেবুলা তিনজনকে সমান চোখে দেখেছে। আর পিতা হয়ে তিনি একটি বিভাজন প্রকট করে দিলেন। আর তা ভাইয়ে ভাইয়ে যতখানি, নেবুলার মনে অনেক বেশি!

যে মানুষটিকে নেবুলা ঠিকই ভালোবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে। কিন্তু তিনি নিজের কাজ ছাড়া নেবুলার দিকে কখনো মনোযোগ দেননি! কোনোদিন নেবুলাকে নিয়ে তিনি কোথাও একটু বেড়াতেও যাননি। বুকের অলিন্দ থেকে আতিপাতি করে নেবুলা স্মৃতির ঝুলি খুলে বসে সেই রাতের মরণদশার ভেতরে। না, তার জীবনে অতৃপ্তি আর গাধার মতো সবার চাপিয়ে দেয়া বোঝার ভার ছাড়া আর কিছুটি নেই তাতে, যা একটু ছায়াদায়ী মেঘ হয়ে এমন ভয়ঙ্কর মুহূর্তে তাকে রক্ষা করে।
নেবুলা জানে, তার নিজের বড় ছেলেটি কানাডা গিয়ে যখন আর ফিরে আসার চেয়ে না আসার অবস্থাই পাকাপাকি করে ফেলেছে, সেখানে ছোট ছেলেও কি ফিরে আসবে? তাহলে কি তার নিজের জীবন নিঃষঙ্গতায় এভাবেই মরুভূমি হয়ে থাকবে! শেষ জীবনে কি হবে তা নিয়ে অবশ্য নেবুলা ভাবে না। ছেলেদেরও তো সে খালি স্বপ্ন দেখিয়েছে আকাশ ছুঁতে। পিছনে ফিরে তাকাতে তো সে-ই তাদেরকে শেখায়নি! তাই তারা পিছুটান হতে তার নিজেরও ভূমিকা আছে।
সংসারের কোনো কাজও কোনোদিন কারো সাথে পরামর্শ করে করেনি নেবুলা। আর আজ তার এই বিজ্ঞাপণ দেয়ার কথাও সে কাউকে বলেনি! কার কাছেই বা বলবে সে। তার তো তেমন কেউ নেইও। যারা আছে, তারা শুধু খুঁটে খেতে আসে! এত সূক্ষ্ম এত সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কি যার তার সাথে কথা বলা যায়! মা-বাবাও তো শুধু জামাইয়ের ঐশ্বর্য-প্রতিপত্তি দেখেছে। অবশ্য এত বছর পরে এ নিয়ে আর কারো প্রতি তার অভিযোগ নেই। সে 
নিজগুণে সব মানিয়ে নিয়েছিল।
নেবুলা জানে, বন্ধুদের কারো সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করতে গেলে সে-ই হয়ত ঢিঢি ফেলবে! তবু একদিন বিষয়বুদ্ধিতে পাকা তার থেকে দশ বছরের বড় এক বান্ধবী তার বাসায় এলে, নেবুলার মোবাইলে কতক্ষণ পরপর টুং টুং করে মেসেজ আসতে দেখে, সে কপাল কুঁচকে বললো, তোর এত মেসেজ আসছে কেন রে?
 নেবুলা তাকে বলে ফেলল, জানিস সুরমা আপা, আমি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপণ দিয়েছি!
সুরমা স্বাভাকিক স্বরে বলল, কিসের? এই ফ্ল্যাট বিক্রি করে তুইও কি ছেলেদের কাছে চলে যাবি নাকি? নাকি কোনো জমি বিক্রি করবি?
সুরমার কথা নেবুলার কানে ঢোকে না। সে নিজের কথা বলে যায়-জানিস্, আগে কোনোদিনও আমার এরকম হয়নি, কয়েকদিন আগে রাতে আমার খুব হাঁসফাঁস লাগছিল। আমার তখন মনে হচ্ছিল এই যে আমি একা। সমস্ত জীবন গেল আমার একাকীত্ব বয়ে। তাতে কার কি? আবার কেউ একজন যদি আমার পাশে থাকত, তাতেই বা কার কি ক্ষতি হত?
সুরমা বললো, তোর হাজবেণ্ডের ওই ছেলেটা কোথায়?
: হাজবেণ্ডের একা ছেলে হবে কেন, ত্রিশ বছর ধরে তো আমারও ছেলে ঋভু।
: তুই একা বললে হবে?
: আমারটুকু তো আমি বলবোই। অন্যেরা অন্যেরটুকু বলুক!
: ও তোকে দেখতে আসে না?
: নিজের থেকে আসে না বলে আমিও এখন আসতে বলি না! তবে ও ভালো আছে! মা-বাবার একমাত্র মেয়ে বিয়ে করে সুখেই আছে।
 : আচ্ছা শোন, তুই অকাল বিধবা মানুষ। আমার চোখের সামনেই তো তোর বিয়ে, বৈধব্য সব ঘটলো। তুই যদি আরেকটা বিয়ে করতি তোর ছেলেরা তা মেনে নিতো?
: না রে, ওইরকম করে ভাববার সাহসই তো পাইনি। আমি তো তাদের লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো বিষয়-আশয়ের সাথে ইনভলব পযর্ন্ত করিনি! এমন কি ঋভুকেও না! আমরা সবাই কেমন জানিস তো, কারো জন্য কেউ মরিয়া নই। ছেলেরা এমন নয়, যে বলবে মা কোথাও যেও না, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। কিন্তু আমি নিজ দায়িত্বে কোথাও যাই না। মনে হয়, ওরা নাড়ির বন্ধন থেকে ছুটে গেলে, ওরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে ওদের জীবনে আর আমার কি দরকার থাকবে! তাই তো নিজের গরজে নিজের ভাললাগা থেকে এই সংসার আর সন্তান দুটি নিয়ে নিমগ্ন থেকে গেলাম। ঋভু তো বড় হয়ে তার মামা-খালাদের কথায় আমার সাথে বিবাদে মত্ত হয়ে উঠেছিল। পরে তার বাবা তাকে ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটটি লিখে দেয় এবং বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবু ঋভুর জন্যও কিন্তু আমার টান কম ছিল না জানিস! কিন্তু রাগটা ওদের বাবার ওপর।
:কিন্তু সব টান ছিঁড়ল তো?
: হ্যাঁ! যা বলছিলি, আমার এইরকম মনে হয়, মানানসই কাউকে পেলে আমার ছেলেরা বোধহয় আপত্তি করত না।
: তোর আসলে শামীমকে বিদেশ পাঠানো ঠিক হয়নি!
: ধুর, আমার জীবনের আর এত কিই বা দাম যে আমি আমার সন্তানদের খর্ব করে রাখব!
: খর্ব বলছিস কেন? এদেশে কি লেখাপড়া হচ্ছে না?
: হবে না কেন? কিন্তু যে যেখানে যেতে চায়, সামর্থ থাকলে তো যেতে দিতে হয়। সামর্থ না থাকলে যেতে চাইলেও পাঠাতে পাঠাতাম না। যেমন ঋভু কখনো চায়নি। আর ওরা দু’ভাই-ই তো  স্কলারশীপ পেয়ে গেছে। আমার খুব একটা খরচ হয়নি!
: কিন্তু দেখিস, তোর জন্য কেউ ফিরে আসবে না!