তারাবির নামাজ ৮ রাকাত পড়লেই কি হয়?

ইসলাম ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৯:৫৮ এএম, ১১ এপ্রিল ২০২২ সোমবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

পবিত্র রমজান মাসে মুমিনদের জন্য একটি বিশেষ নামাজের বিধান দেওয়া হয়েছে। বছরের আর কোনো মাসে এই নামাজ পড়ার বিধান নেই। বিশেষ এই নামাজের নাম ‘তারাবি’। তারাবি আরবি শব্দ ‘তারবিহাতুন’-এর বহুবচন। এর অর্থ হলো- আরাম করা ও বিশ্রাম করা।

ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, তারাবির নামাজে প্রতি চার রাকাত পর পর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়ার বিধান রয়েছে। তাই এ নামাজকে তারাবির বা প্রশান্তির নামাজ বলা হয়।

তারাবির নামাজের রাকাত

তারাবির নামাজ বিশ রাকাত। তারাবির নামাজকে আট রাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা অনুচিত। পবিত্র রমজান মাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল এই তারাবির নামাজ। এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আল্লাহর রাসুল (সা.) তিন দিন এই নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করেছেন। তিনি নিয়মিত সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ আদায় করলে, তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই পুরো রমজানে তিনি জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেননি।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবির নামাজ পড়ার প্রচলন ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর যুগে। সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তখন আর এটি ফরজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কেননা মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাধ্যমে ওহির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
তাবেঈ ইবনে আবি জুবাব (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রা.)-এর যুগে রমজানের তারাবি ছিল তেইশ রাকাত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৭৩৩)

প্রখ্যাত তাবেঈ আবদুল আজিজ ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, ‘উবাই ইবনে কাব (রা.) রমজানে মদিনায় লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : হাদিস : ৭৭৬৬)

আমিরুল মুমিনিন ওমর (রা.)-এর খেলাফতকাল থেকে অবিচ্ছিন্নভাবে এখন পর্যন্ত মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম ও মদিনা শরিফের মসজিদে নববীসহ সব মসজিদে বিশ রাকাত তারাবির ধারা চলে আসছে। এ দীর্ঘ সময়ে কোথাও আট রাকাত তারাবির প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম ১২৮৪ সালে ভারতবর্ষের একজন নামধারী আহলে হাদিস আট রাকাতের ফতোয়া দিয়ে উম্মাহর ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলায় বিভক্তি সৃষ্টি করেন। তখন অন্যান্য আহলে হাদিসও তাঁর বিরোধিতা করেছেন। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে আরবের কয়েকজন আলেমও তাঁর সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন। আরববিশ্বের অধিকাংশ আলেম এর বিরোধিতা করেন এবং অনেকেই আট রাকাতের অভিমতকে জোরালোভাবে খণ্ডন করে কিতাব লেখেন।

ওমর (রা.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরামের আমল

এক. ইয়াজিদ ইবনে খুসাইফা (রহ.) বলেন, সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন। তিনি আরো বলেন, তাঁরা নামাজে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সুরা পড়তেন। আর হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে দীর্ঘ নামাজের কারণে তাদের কেউ কেউ লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকি : ২/৪৯৬/৪২৮৮) হাদিসটিকে ইমাম নববী, ইরাকি, আইনি, সুয়ুতি (রহ.) প্রমুখ হাদিস বিশারদও সহিহ বলেছেন।

অন্য সূত্রে সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেন, আমরা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে ২০ রাকাত তারাবিহ ও বিতর পড়তাম। (আস সুনানুল কুবরা, বায়হাকি : ১/২৬৭-২৬৮, মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার, বায়হাকি, হাদিস : ৫৪০৯) এ সূত্রকে সহিহ বলেছেন আল্লামা সুবকি ও মোল্লা আলী কারি (রহ.) প্রমুখ হাদিস বিশারদ ।

কোনো কোনো লা-মাজহাবি এ হাদিসের ওপর আপত্তি করেন যে ইমাম মালেক (রহ.) ‘মুয়াত্তা মালেকে’র মধ্যে হাদিসটিতে ১১ রাকাতের কথা উল্লেখ রয়েছে। আসলে হাদিসটি সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা.)-এর চারজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে শুধু একজন ছাত্র ভুলে ১১ রাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। আর বাকি তিনজন ছাত্র ২০ রাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। ইমাম মালেক (রহ.) ওই একজনের বর্ণনাটি উল্লেখ করেন। তাই হাদিসশাস্ত্রের পরিভাষায় ওই একজনের বর্ণনাটিকে বলা হয় ‘শাজ’ বর্ণনা, যা শাস্ত্রবিদদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। (আওজাজুল মাসালিক : ১/৩৯৪)

দুই. তাবেঈ ইবনে আবি জুবাব (রহ.) বলেন, ওমর (রা.)-এর যুগে রমজানের কিয়াম তথা তারাবি ছিল ২৩ রাকাত। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৭৩৩) হাদিসটির সূত্র বিশুদ্ধ। এখানে ২৩ রাকাতের উদ্দেশ্য হলো, ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর।

তিন. তাবেঈ আবদুল আজিজ ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, উবাই ইবনে কাব (রা.) রমজানে মদিনায় লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২/২৮৫/৭৭৬৬)

চার. তাবেঈ ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আনসারি (রহ.) বলেন, ওমর (রা.) এক ব্যক্তিকে আদেশ দেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত পড়েন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২/২৮৫/৭৭৬৪)

পাঁচ. বুখারির আগে লিখিত ও পৃথিবীর প্রথম সহিহ হাদিসগ্রন্থ ‘মুয়াত্তা মালিক’সহ অন্যান্য কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। তাবেঈ ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রহ.) বলেন, হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে লোকেরা রমজানে ২৩ রাকাত তারাবি পড়তেন। (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ৩৮০, আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকি, হাদিস : ৪২৪৯)

আলী (রা.)-এর যুগে সাহাবিদের আমল

বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম আবু আবদুর রহমান সুলামি (রহ.) বলেন, আলী (রা.) রমজানে হাফেজদের ডাকেন এবং তাঁদের একজনকে লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি পড়ানোর নির্দেশ দিলেন। তিনি বলেন, আলী (রা.) তাঁদের নিয়ে বিতর পড়তেন। (সুনানুল বায়হাকি : ২/৪৯৬-৪৯৭/৪২৯১)

তাবেঈ আবুল হাসনা (রহ.) বলেন, আলী (রা.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি পড়েন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২/২৮৫/৭৭৬৩)

উপরোক্ত বর্ণনাগুলোসহ অন্যান্য বর্ণনা, সাহাবি-তাবেঈনের সর্বসম্মত আমলের আলোকে ও যুগ যুগ ধরে চলে আসা সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মের ভিত্তিতে আলেমদের অভিমত হলো, ২০ রাকাত তারাবি সুন্নাতে মুআক্কাদা। বিনা ওজরে এর কম পড়লে সুন্নাতে মুআক্কাদা ছেড়ে দেওয়ার গুনাহ হবে।

আট রাকাত নিয়ে বিভ্রান্তি ও নিরসন

এক. যারা বর্তমানে আট রাকাত তারাবির প্রচার করছেন, তাঁদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল হলো বুখারি শরিফের একটি হাদিস। আসলে হাদিসটি তারাবি সম্পর্কেই নয়; বরং তা হলো তাহাজ্জুদ-সংক্রান্ত একটি হাদিস। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু সালামা (রহ.) আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নামাজ কী ধরনের হতো? আয়েশা (রা.) উত্তরে বললেন, রমজানে ও রমজানের বাইরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ১১ রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসা কোরো না। এরপর চার রাকাত পড়তেন, এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসা কোরো না। এরপর তিন রাকাত পড়তেন। (বুখারি, হাদিস : ১১৪৭, ২০১৩, ৩৫৬৯)

এ হাদিসটি যে তারাবি সম্পর্কে নয়, এর অনেক প্রমাণ আছে। যথা—

ক. এখানে ওই নামাজের কথা বলা হয়েছে, যা রমজান ও রমজানের বাইরে পড়া হতো। অথচ রমজানের বাইরে কোনো তারাবি নেই।

খ. ওই নামাজ চার রাকাত চার রাকাত করে আট রাকাত পড়তেন, অথচ তারাবির নামাজ হলো দুই রাকাত করে।

গ. এই নামাজ দ্বারা যদি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে আট রাকাত তারাবিই প্রমাণিত হতো, তাহলে কি সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে ২০ রাকাত পড়তেন? (নাউজুবিল্লাহ!)

ঘ. ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ, ইমাম মালেক, আব্দুর রাজ্জাক দারেমি, ইবনে খুজাইমা (রহ.)সহ অনেক মুহাদ্দিস এ হাদিস নিজ নিজ হাদিসগ্রন্থে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। খোদ ইমাম বুখারি (রহ.)ও হাদিসটি বুখারি শরিফের তিন জায়গায় উল্লেখ করেন—তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে, কিয়ামে রমজান ও বিতর অধ্যায়ে।

ঙ. অন্যদিকে হাদিসটির বর্ণনাকারী হজরত আয়েশা (রা.)ও মনে করতেন না যে এটি তারাবি সম্পর্কে। নতুবা তাঁর চোখের সামনে ৪০ বছর মসজিদে নববীতে তাঁরই হুজরার পাশে সাহাবিরা সুন্নাত পরিপন্থী (!) কাজ করবেন আর তিনি চুপ থাকবেন, এটা অসম্ভব ও অকল্পনীয়।

চ. তা ছাড়া হাদিসটিকে লা-মাজহাবিদের গুরুপর্যায়ের অনেক আলিমও তারাবি সম্পর্কে মনে করতেন না। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত তারাবির রাকাত সম্পর্কে কোনো বর্ণনা নেই।’ (মাজমাউল ফাতাওয়া : ২২/২৭২) এতে জানা যায়, বুখারি শরিফের এই হাদিসকে তিনিও তারাবি সম্পর্কে গ্রহণ করেননি।

দুই. তারা আরেকটি দলিল দিয়ে থাকেন, ‘উবাই ইবনে কাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর ঘরের নারীদের নিয়ে রমজানে আট রাকাত নামাজ পড়েছেন।’ (মুসনাদে আবি ইয়ালা : ১৭৯৫)

অথচ হাদিসটি সূত্রের বিচারে অগ্রহণযোগ্য। কারণ তাতে ঈসা ইবনে জারিয়া নামক দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। ইমাম ইবনে মাঈন (রহ.) বলেন, তাঁর হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। (তাহজিবুত তাহজিব : ৮/২০৭)

সুতরাং তারাবির রাকাত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কেননা যেখানে আট রাকাতের কথা আছে, সেটি মূলত তাহাজ্জুদসংক্রান্ত হাদিস। মহানবী (সা.) রমজানে ও রমজানের বাইরে প্রতি রাতে আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতরের নামাজ পড়তেন। মহান আল্লাহ আমাদের উপলব্ধি ও আমল করার তাওফিক দান করুন।