গল্পের বই: আট রকমের গল্প

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৩:২০ পিএম, ২৪ মে ২০২১ সোমবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দেওয়ান শামসুর রকিবের গল্পের বই ‘আট রকমের গল্প’ পড়লাম। বইটিতে আটটি গল্প সংযোজন করা হয়েছে। প্রতিটি গল্পই নতুন ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম গল্পটি ‘ক্ষমা অথবা দ্বিধা’। আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। নারীকে কাছে পাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা পুরুষের সর্বকালীন। পছন্দের নারীকে পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করেই থাকে। কিন্তু পাওয়ার পর যেন ভিন্ন মানুষ হয়ে যায়। নানা স্বপ্নের কথা শুনিয়ে নারীকে ভোলালেও বিয়ের পরপরই পুরুষ হয়ে যায় তথাকথিত সমাজেরই এক বাস্তব চিত্র! গল্পের নায়ক শমিক ঠিক তাই করেছিল। নায়িকা রিয়া আশাহত হতে হতে একসময় সরে দাঁড়ায়। শমিক আবার বিয়ে করে। কিন্তু নিয়তি তাকে এক্সিডেন্টের সামনে দাঁড় করায়। শমিক যখন মৃত্যুপথযাত্রী; তখন তার শাশুড়ির টনক নড়ে। রিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে শমিক পরপারে পাড়ি জমায়। রিয়া তখন কী করবে! ক্ষমা করলেই শমিক ফিরবে? তার হারানো সময় ফিরে পাবে? নানা প্রশ্নে সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের এই সাবকন্টিনেন্টে এ চিত্র হরহামেশাই দেখা যায়। অথচ নারীর প্রতি একটু সদয় (!) হলে একটু ভালোবাসলে, নারীকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে সবাই শান্তিতে থাকতে পারে। ‘সময় গেলে সাধন মিলে না’ গল্পকার এখানে দারুণ মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।

দ্বিতীয় গল্প ‘করোনাবন্দি দিনগুলো’ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। বিয়ের সব ঠিক। এরই মাঝে করোনাকালীন জটিলতায় লকডাউন শুরু হলো। ছেলের মা সরাসরি মেয়ের মাকে বললো, ‘বেয়াইন আপনার মেয়ের কপাল খারাপ, না হলে বিয়ের সময় এই অবস্থা কেন হবে? এখন আমরা কে বাঁচি না বাঁচি বলা তো যায় না।’ এই যে খারাপ হলে মেয়ের দোষ ভালো হলে ছেলের কপাল এ ধরনের সেন্টিমেন্ট আলবৎ নারীদের প্রেস্টিজ ইস্যু! কেন ছেলের কপাল খারাপ হতে পারতো না! ফলে নাসিম এবং শিলার বিয়েটা ভেঙে গেলো।

তৃতীয় গল্পটি ‘ডাল, ভাত, আলু ভর্তা’। এ গল্পের নায়ক আরিফ। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত হলো তখন একা। কারণ শিক্ষিত স্মার্ট নারী সবার পছন্দ কিন্তু সে নারী যদি নিজের পায়ে দাঁড়ায়। আর যদি সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা জন্মায় তখন তাকে স্বয়ং বিধাতাও মনে হয় পছন্দ করে না! নাজনীনকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। সে ঘর গোছাচ্ছে, রান্না করছে, জুতা পালিশ থেকে নক কাটা সবাই করছে। কিন্তু যখন তার চাকরি হলো তা আর আরিফ সহ্য করলো না। তাকে না জানিয়ে ইন্টারভিউ যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে! আরিফের দ্বিতীয় মূর্তি দেখে নাজনীন আরিফকে ছেড়ে দেয়, চাকরি বেছে নেয়। এই যে সামাজিক ব্যাধি নারী কেবল মাংসের দলা মুখের থুথু ভাবা দ্বাবিংশ শতাব্দিতে এসেও তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। আমাদের মেয়েরা চাকরি করছে বটে কিন্তু তাদের পরিবারের সবাইকে খুশি রেখে তবেই কাজ করতে হচ্ছে। শুধু পুরুষ নয়, নারীরাই নারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। তারা যে মানুষ তাদের যে একটা আইডেনটিটি হতে পারে, তা-ই তারা জানেন না। চিরকাল অমুকের বউ অমুকের মা হয়ে কেবল গাধার মতো নীরবে খেটে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই শিখলো না! এই সুযোগে পুরুষ বলবে, তোমার কিসের অভাব বলো? শিক্ষিত নারী বলতে পারে না আইডেনটিটির অভাব! গল্পটি নারীর চেতনা উদয় হওয়ার জন্য আবশ্যকীয় একটি গল্প।

চতুর্থ গল্পটি ‘খুনির মেয়ের কোন অপরাধ ছিলো না!’ পিতার অপরাধে কন্যাকে আজীবন অপরাধী থাকতে হয় আমাদের সমাজে। মনে করুন একজন পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেললো। ব্যস হয়ে গেলো! তার মেয়ের বিয়ে এক কোটিবার ভাঙবে। কারণ তার বাপের আরেকটি বউ আছে। বিয়ে হলেও শ্বশুরবাড়িতে সারাজীবন এর জন্য কথা শুনতে হবে। লাইফ ফালাফালা হয়ে যায়। ঠিক তেমনই কোন কারণে ঠান্ডা মাথায় কিংবা উত্তেজনা বশত কোন পিতা যদি খুন করে, তবে তার মেয়েকে বউ করে আনা যেন জঘন্যতম কাজ। অথচ দেখা যাবে ওই পরিবারে ঘুষখোর, চোগলখোর মানুষে ভরা। তাতে কোন অপরাধ নেই। এমনই এক অবস্থায় সবাই মিলে যখন ঠিক করা বিয়ে ভেঙে দিলো; তখন গল্পের নায়ক কায়সার নায়িকা কণাকে ডেকে প্রপোজ করে। চলুন ‘আমরা বিয়ে করে ফেলি’। কণা কোনভাবেই রাজি হয়নি। কারণ বিয়ে তো শুধু দু’জনের মাঝে হয় না। দু’টো পরিবার এক হয়। দু’টো সমাজ এক হয়। যেখানে কায়সারের পরিবার রাজি নেই; সেখানে বিয়ে হতে পারে না। কায়সার ক্রমাগত কণার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কণার দৃঢ়তার কাছে কায়সার হেরে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয় এবং সুইসাইড করে। কায়সারের বাবা এবার কণার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিয়ে তাকে খুনি বানিয়ে ছাড়ে। এই ঘুণেধরা সমাজের চিত্র দেওয়ান শামসুর রকিব দুর্দান্তভাবে তুলে ধরেছেন এ গল্পে। একের দায় অন্যের ওপর চাপানো এ সমাজের নেশা। লেখক সমাজের নাসারন্ধ্র খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যায়কে ঘৃণা করো, অন্যায়কারীকে নয়। কারণ সে পরিস্থিতির শিকার।

পঞ্চম গল্প ‘নাহিদবিষয়ক কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন’। মানসিক অবসাদ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। পরাজয়, ব্যর্থতা থেকে মানুষের ডিপ্রেশন আসে। সে ডিপ্রেশনের করাল গ্রাসে ব্যক্তি যেমন আক্রান্ত হয়; তেমনই পরিবারটিও সাফার করে। তারই একটি রূপরেখা দারুণভাবে অঙ্কন করেছেন লেখক।

ষষ্ঠ গল্পটি ‘রক্তবীজ’। এখানে টিনএজাররা কেমন করে দলগত অপরাধ করে, অবাধ্য ও অবিবেচক হয়ে বেড়ে ওঠে। তাদের দৌরাত্ম্যর কাছে পিতামাতা কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, এ গল্পে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাঠকের অবশ্যই ভালো লাগবে। সন্তানকে বাস্তবতার সাথে বড় করতে হবে। যখন যা চাইবে, তা-ই তাকে দিতে হবে- এমন কোন কথা নেই। অভাব বুঝতে দিতে হবে। সমস্যায় পড়লে তা থেকে উত্তরণে তাকেই কৌশলী হতে হবে, এ শিক্ষা দিতে হবে। মানবতা শিক্ষা দিতে হবে। ঐশীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। একদিনে ঐশী খারাপ হয়নি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেয়ে পেয়ে সে ভুল পথে গিয়েছে। ‘রক্তবীজ’ গল্পে তারই প্রতিধ্বনি বেজেছে।

সপ্তম গল্প ‘ঢেউ’। গল্পটি দু’টো দিক নির্দেশ করেছে। এক উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদের সন্তানরা ইউরোপ-আমেরিকায় যায়। সেখানকার উন্নত পরিবেশে খাপ খাওয়ার পর আর দেশে আসতে চায় না। তাদের জন্য পিতা-মাতার অপেক্ষা ফুরোয় না। কষ্ট পেলেও অভিশাপ দেয় না। সন্তানের মঙ্গল কামনায় ব্যস্ত থাকে।

অন্যদিকে মাকে ছেড়ে ছেলে বউ নিয়ে আলাদা সংসার করলেও মা সন্তানকে ভুলে যেতে পারে না। সালমার ছেলে সালমাকে অপমান করে চলে গেলেও ছেলে যখন রঙের কাজ করতে গিয়ে উপর থেকে পড়ে আহত হলো; তখন সালমা দৌড়ে এসে মালিকের কাছে কান্না জুড়ে দেয়, ‘আমার ছেলেরে বাঁচান খালাম্মা... আমার ছেলেরে বাঁচান।’ মা চিরকালীন, শ্বাশত। মায়ের বিকল্প কিছুই নেই। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি সন্তান তার পিতা-মাতাকে অবহেলায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য থেকে হেন কোন অপমান নেই, যা তারা করে না। মা গৌণ কিছু হয়ে যায়। সংসারের গার্বেজ। মনে রাখা উচিত, একদিন তাদের এ মা-বাবাই লালন-পালন করেছে। এখন যেমন তারা তাদের সন্তানকে লালন-পালন করছে।

বইয়ের শেষ গল্প ‘এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’। গল্পটিও পাঠককে নাড়া দেবে বলে আমার বিশ্বাস। দেওয়ান শামসুর রকিবের ‘আট রকমের গল্প’ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশিত হয়েছে বেহুলা বাংলা থেকে। দাম ২২৫ টাকা। বইটির পাঠ নিতে পারেন সানন্দ চিত্তে। লেখকের জন্য শুভ কামনা রইলো।