হাদিসের আলোকে জীবনযাপনে প্রশান্তি লাভের উপায়

ধর্ম ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০১:৫৭ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০২১ রোববার

ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, তিনটি বিষয় মানুষকে মুক্তি দেয়। এক. আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা নির্জনে ও লোকসমাগমে (বা প্রকাশ্যে ও গোপনে)। দুই. কেউ সন্তুষ্ট বা রেগে গেলেও সামনে সত্য কথা বলে দেয়া। তিন. দারিদ্রতা ও স্বচ্ছলতা উভয় অবস্থায় মধ্যমপন্থায় খরচ করা। আর তিনটি বিষয় মানুষকে ধ্বংস করে। 

এক. নফসের খায়েশাতের অনুসরণ করা। দুই. কৃপণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে জীবন যাপন করা। তিন.  আত্মগরিমা ও অহংকার রোগে ভোগা। এই তৃতীয়টি এগুলোর মাঝে সবচেয়ে ক্ষতিকর। (বাইহাকি শুয়াবুল ইমান) মুসনাদে আহমদ ও বাইহাকির অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘চারটি গুণ হাসিল করতে পারলে সারা দুনিয়া ছুটে গেলেও কোন সমস্যা নেই। 

এক. আমানতের হেফাজত করা। দুই. সত্য কথা বলা। তিনি. সুন্দর চরিত্র। চার. জীবিকা অর্জনে সতর্কতা।’ অনেকগুলো গুণের কথা বলা হলেও সবের মূলে রয়েছে একটি। তা হচ্ছে তাকওয়া।

তাকওয়ার পরিচয়
তাকওয়া আরবি শব্দ। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে ভয় করা, বেঁচে থাকা ইত্যাদি। তাকওয়ার পরিচয় বিভিন্নভাবে দেয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে উত্তম পরিচয় দিয়েছেন হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) যখন হজরত উমর (রা.) তাকে তাকওয়ার পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। হজরত উমর (রা.) তাকে প্রশ্ন করেছিলেন তাকওয়া কী? হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনি কখনো এমন রাস্তা দিয়ে গিয়েছেন যা কাটায় পরিপূর্ণ? হজরত উমর (রা.) বলেন, কয়েক বার গিয়েছি। হজরত উবাই ইবনে কাব বলেন, ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আপনি কেমন করতেন? হজরত উমর (রা.) বলেন, কাপড় গুটিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে যেতাম। তখন হজরত উবাই ইবনে কাব বলেন, ব্যস, এর নামই হচ্ছে তাকওয়া। এই দুনিয়া হচ্ছে কন্টাকাকীর্ণ পথ। 

গুনাহের কাটায় এটা ভরপুর। তাই এখানে এরকমভাবে চলা যেন গুনাহের কাটা দ্বারা ক্ষতবিক্ষত না হয়। আর এর নামই হচ্ছে তাকওয়া। দুনিয়াতে এটাই সবচেয়ে দামি বস্তু।’ হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, মানুষ জাগতিক ভোগবিলাসিতা ও সম্পদের পেছনে পড়ে থাকে। অথচ দুনিয়ার বুকে সবচেয় দামি বস্তু তাকওয়া। (মাআরেফুল কোরআন, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৪২) 

তাকওয়ার স্তর
যে ব্যক্তি তাকওয়া অর্জন করে তাকে বলা হয় মুত্তাকী। কারণ, মুত্তাকী আখেরাতের ক্ষতিকর, কষ্টদায়ক বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে। মুত্তাকি লোকদের তিনটি স্তর রয়েছে-

এক. শুধু কুফুর ও শিরক হতে নিজেকে রক্ষা করে চলা। এটা তাকওয়ার সর্বনিম্ন পর্যায়।

দুই. কুফুর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কবিরা গুনাহ থেকেও নিজেকে রক্ষা করা এটা তাকওয়ার দ্বিতীয় স্তর।

তিন. কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুত্তাকি হচ্ছেন ওই ব্যক্তি যে শুধু কুফুর, শিরক ও অন্যান্য গুনাহ থেকেই নিজেকে পবিত্র রাখে না বরং শরীয়ত যেগুলোকে অনর্থক কাজ সাব্যস্ত করেছে সেগুলো থেকেও নিজেকে রক্ষা করে চলে। প্রকৃত অর্থে তারাই মুত্তাকি। আল কোরআনে মুমেনকে এই পর্যায়ের তাকওয়া হাসিল করে দুনিয়া থেকে যেতে বলেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যথাযথ ভয়। আর তোমরা দুনিয়া থেকে যেয়ো না খাঁটি মুমিন হওয়া ছাড়া। (সূরা আল ইমরান, আয়াত নং-১০২) 

হজরত শাহর ইবনে হাওশাব (রা.) বলেন, ‘মুত্তাকি ওই ব্যক্তি যে হারাম ও গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ওই সব কাজও ছেড়ে দেয়, যাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই (কিন্তু বৈধ বা অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে সংশয় থাকে)। (তাফসিরে মাজহারি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৮)

এই প্রসঙ্গে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, হজরত নুমান ইবনে ইবনে বশীর (রা.) এর সূত্রে নবী করিম (সা.) বলেন, হালাল ও হারাম সুস্পষ্ট। এ’দুয়ের মাঝে অনেক বিষয় রয়েছে যা সংশয়পূর্ণ এবং অধিকাংশ মানুষের এব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

অতএব যে ব্যক্তি সংশয়পূর্ণ এসব বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে সে নিজের দ্বীনদারিকে পবিত্র রাখতে পারবে। যে সংশয়পূর্ণ বিষয়গুলো করবে সে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন কোনো রাখাল নিষিদ্ধ ভূমির আশাপাশে ছাগল চড়ালে আশঙ্কা থাকে যে, তার ছাগল অচিরেই ওই নিষিদ্ধ ভূমিতে ঢুকে যাবে। শোন! শোন! জমীনের বুকে আল্লাহর নিষিদ্ধ ভূমি হচ্ছে তার হারাম বিধিবিধানগুলো।’ তারপর রাসুল (সা.) বলেন, প্রত্যেকের দেহে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে ওই অঙ্গটি ঠিক হয়ে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। আর এর নাম হচ্ছে কলব।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২০৫১)

তবরানি শরীফের এক হাদিসে এসেছে হালাল, হারাম সুস্পষ্ট। আর যা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় তুমি তা ছেড়ে ওই বস্তু গ্রহণ করো যেখানে কোন সন্দেহ নেই।’

তাকওয়ার উপকারিতা
তাকওয়া এমন গুণ যার দ্বারা মানুষের ভেতরে প্রশান্তি লাভ হয়। আল্লাহ তায়ালার বন্ধুত্ব হাসিল হয়। আল কোরআনে এসেছে, আল্লাহ তায়ালার বন্ধু কেবল মুত্তাকী লোকেরাই।’ রিজিকের সংকীর্ণতা দূর হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর ভয় অর্জন করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য বের হওয়ার রাস্তা করে দিবেন এবং এমন জায়গা থেকে রিজিক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনি।’ দুনিয়ার জীবনে মানুষের ভালোবাসা লাভ হয়।

তাকওয়া অর্জনের উপায়
এক. আল্লাহওয়ালা বান্দাদের সংশ্রব লাভ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা তাকওয়া অর্জন করো এবং নেককার লোকদের সঙ্গী হও।’ (সূরা তাওবা-১১৯)

দুই. সততা ও সত্য কথা বলা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তাকওয়া অর্জন করো এবং সত্য কথা বলো।’ (সূরা আহযাব-৭০) উল্লেখিত উভয় আয়াতে তাকওয়া অর্জনের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে দুটি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত এগুলো হচ্ছে তাকওয়া অর্জনের সহায়ক। আল্লাহ আমাদেরকে তাকওয়া অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।