মাহে রজবের ফজিলত ও আমলসমূহ

ধর্ম ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ১০:৪৫ এএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

শুরু হয়েছে মাহে রজব। সম্মানিত মাস। রমজানকে স্বাগত জানানোর মাস। ফতোয়া গ্রন্থে উল্লেখ আছে, মুসলিম জাতির জন্য আরবি মাসের গণনা করা, হিসাব রাখা ফরজে কেফায়া। অল্পসংখ্যক লোক নিয়মিত হিসাব রাখলে ফরজিয়াত আদায় হয়ে যাবে। যদি কেউ না রাখে তবে সবাই গোনাহগার হবে।

কেননা আরবি মাসের উপর ভর করে মুসলমানদের বহু বিধি-বিধান আবর্তিত হয়। যদি কখনো তারা আরবি মাসের হিসাব ছেড়ে দেয়, তাহলে তারা ধর্মীয় দিক দিয়ে বিশাল ক্ষতির মাঝে পড়বে। তাই ইসলাম ধর্মে আরবি মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।  

কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে, বিধানের ক্ষেত্রে গণনার রীতি আল্লাহর কাছে মাস ১২টি। আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। এর মধ্যে চারটি বিশেষ সম্মানের অধিকারী। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং এর মাঝে নিজেদের কোনো ক্ষতি করো না। মুশরিকদের সঙ্গে ওই পরিমাণ যুদ্ধে লিপ্ত হও যে পরিমাণ তারা লিপ্ত হয়। জেনে নাও আল্লাহ মুত্তাকিনদের সঙ্গে রয়েছে। (সুরা তাওবা- ৩৬)

আয়াতে উল্লিখিত সম্মানিত মাস চারটি; যথা- জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। আরবিতে এই চারটিকে আশহুরুল হারাম বলা হয়। রজব হলো এগুলোর অন্যতম মাস। রজব অর্থ হলো সম্মানিত। এ মাসের অনন্য গুরুত্ব রয়েছে। হাদিস শরিফে আছে, হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ১২ মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক যথা- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম অপরটি রজব। 

আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালার বিধান মতে আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বার মাস সেই দিন হতে যেই দিন তিনি আকাশ মন্ডল এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা আত তাওবাহ: ৩৬) 

হাদিসে এসেছে, হযরত আবু বাকরা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ১২ মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক আর তা হচ্ছে- যিলক্বদ, যিলহজ, মহররম আর চতুর্থ মাসটি হল-রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শা’বান মাসের মধ্যবর্তী মাস (সহিহ বোখারি)।

অন্যান্য মাসের মতো রজব মাসের জন্য বিশেষ কিছু নফল আমল রয়েছে, যা আমল করলে আমরা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি এবং জান্নাত লাভের পথ সুগম হবে। 

হাদিস পাঠে জানা যায়, যখন রজব মাস শুরু হত, তখন মহানবী (সা.) দুই হাত তুলে এ দোয়া পাঠ করতেন এবং সাহাবাদের পড়তে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবাও ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা ইলা শাহরির রমাদান’ (মসনদে আহমদ)। 

অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। 

তাই বলা যায় মোমিন মুত্তাকিরা সম্মানিত রজব মাস থেকেই পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। 

তারা রজব মাসেই একটি রুটিন তৈরী করে যে, পূর্বের রমজান থেকে আগত রমজানে কি কি নেক আমল বেশী করবে। 

গত রমজানে যদি একবার পবিত্র কোরআন খতম দিয়ে থাকে তাহলে এবার ইচ্ছা রাখে দু’বার দেয়ার। অর্থাৎ সব কিছুতেই মোমেন চায় পূর্বের তুলনায় বেশী ইবাদত বন্দেগীতে রত থাকতে। 

তাই একজন মোমেন রমজান আসার পূর্বে রজব মাস থেকেই নিজকে রমজানের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করে তোলে। 

বাহ্যিকভাবে আমরা যেমন স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য অনেক পূর্ব থেকেই নিজেকে গড়ে তুলি আর সব সময় মাথায় পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের চিন্তা ঘুরপাক করে ঠিক তেমনি যারা মোমেন তারা রমজানকে শ্বাগত জানানোর জন্য রজব মাস থেকেই তৈরী হয়ে থাকে। 

আসলে সম্মানিত রজব মাস আমাদেরকে রমজানের ইবাদতের জন্য প্রস্তুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসূলকে (সা.) রজব ও শাবান মাসে এত বেশি রোজা রাখতে দেখেছি, রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে এত রোজা রাখতে দেখিনি। 

স্রষ্টার পরে মাখলুকের মধ্যে রাসূলেপাক (সা.) এর প্রথম স্থান হওয়ার পরেও তিনি রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে রজব মাস থেকে রোজা রাখা শুরু করতেন। 

তাই আমরাও যদি এই রজব মাস থেকে পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতি নিতে থাকি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে শুরু করি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সুস্থ্য রাখ আমি যেন আগত রমজানে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী ইবাদত-বন্দেগী, দানখয়রাত, কোরআন পাঠসহ সব পুণ্য কর্ম বেশি বেশি করতে পারি। 

এছাড়া হজরত রাসূল করিম (সা.) শাবান মাসেও অনেক বেশি ইবাদত করতেন আর তিনি (সা.) রমজান ছাড়াও প্রতি মাসে নফল রোজা রাখতেন আর বিশেষ করে রজব মাসে। 

আমরাও যদি মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ি প্রতি মাসে কয়েকটি করে নফল রোজা রাখি তাহলে রমজানের রোজা আমাদের জন্য আরো সহজ হবে। 

এছাড়া আমরা যদি মনের সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রজব মাস থেকেই রমজানের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি গ্রহণ করি তাহলে আমাদের সব ইবাদত বন্দেগী হবে প্রশান্তিময়। 

তাই আসুন, পবিত্র মাহে রমজানকে স্বাগত জানাতে এই রজব মাস থেকেই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করে নেই। 

আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সম্মানিত রজব মাসের তাৎপর্য বুঝার এবং এর ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন।

কোরআন হাদিসে রজব মাসকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদেরও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এ মাসের নফল ইবাদতে অন্য মাসের চেয়ে অধিক সওয়াব লাভ হয়। তবে শরিয়তের বিধান মতে এ মাসে নির্দিষ্ট আমল নেই। আমলের কথাও নেই। 

অন্য মাসগুলোর মতো ফরজ ও ওয়াজিবের পাশাপাশি নফল ইবাদতে মনোনিবেশ করা। নির্ধারিত ইবাদত আছে এমন ধারণা পরিহার করা। এ মাসের গুরুত্ব আছে বলে নফল ইবাদতে গুরুত্ব দেয়া। আর গুরুত্বের কারণেই অন্য মাসের চেয়ে অধিক সওয়াব লাভের আশা করা যায়। এ মাসে বিশেষ নামাজ বিশেষ রোজা আছে বলে সমাজে যে প্রচলিত আছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। এ ধরনের বানোয়ট আমল দিয়ে রজব মাসের ফজিলত লাভ করা যাবে না। 

জাহেলি যুগের রজব পালন
জাহেলি যুগে ও ইসলামের প্রাক্কালে রজব মাসে ছিল নানা কুসংস্কারে ভরপুর। নানা দেবদেবীর নামে পেশ করা হতো মূল্যবান অর্ঘ্য। জাহেলি যুগে বিভিন্ন সম্প্রদায় রজব মাসে বিশেষ উৎসব আনন্দ অনুষ্ঠান করত। মুশরিক সম্প্রদায় তাদের দেবতার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে গরু-মহিষ বনজঙ্গলে ছেড়ে দিত। পশুকে দেবতার নামে ছেড়ে দেয় এ মাসে বহু প্রাপ্তির আশা মনে করা হতো। কেউ কেউ আবার এ মাসে দেবতার সন্তুষ্টিকল্পে পশু জবাই দিত। এ প্রচলন মুসলমানদের মাঝেও ছিল। পশু জবাইয়ের এ প্রচলনকে আতিরা বা রজাবিয়্যা বলা হতো। অতপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এ প্রচলন রহিত করে দেন। তিনি বলেন, ইসলামে আতিরা নেই। আতিরা রহিত হওয়ার বিষয়ে সব হাদিসবেত্তা একমত। সিহাহ সিত্তার সব ইমাম আতিরা রহিত হওয়ার হাদিসটি এনেছেন। ইমাম জুহরি রহ. ইবনে মুসাইয়াব রহ. থেকে তিনি এনেছেন আবু হুরায়রা (রা.) থেকে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, লা ফারা ও আতিরাহ অর্থাৎ মাদি জন্তুর প্রথম বাচ্চা জবাহ করা ও আতিরা করার বিধান আর নেই। (আরবীয়রা মাদি জন্তুর প্রথম বাচ্চাকে দেবীর নামে উৎসর্গ করতো, আর এটাকে আরবিতে ফারা বলে) বুখারি, মুসলিম।

বর্তমানে অনেক মানুষ অনেক স্থানে সেই কুসংস্কারের দিকে জড়িয়ে পড়ছে। রজব আসলে ইবাদতের নামে এমন আমল করে, যা নিষিদ্ধ ও শরিয়তে তার কোনো ভিত্তি নেই। এখনো কোনো কোনো স্থানে রজব মাসে এমন ইবাদত করা হয় যা জাহেলি যুগে করা হতো। আবার কাউকে দেখা যায়, এ মাসে খাজা মাইনুদ্দীন চিশতি রহ. এর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এটিকে শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ আমল বা কাজ মনে করে। এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। 

রজব মাস এলে অন্য আরেকটি বিষয় আমাদের মাঝে আসে। আর তা হলো শবে ‘মিরাজ’। রজবের ২৭ তারিখ রাতে তথা মিরাজ রজনিতে কোনো আমল বা ইবাদত সহিহ হাদিসে আসেনি। আবার মিরাজের নির্দিষ্ট তারিখ কেউ মনেও রাখেনি। মিরাজের সঠিক তারিখ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তবে যদি কেউ এ রাতে ইবাদত বা পরদিন রোজা রাখে সে সওয়াব পাবে অন্য মাসের মতো। 

আমাদের এটা মনে রাখতে হবে, রজব মাসের পরের মাস শাবান। এর পরই হলো মহিমান্বিত ‘রমজান’। রজব মাস থেকে রমজানের প্রস্তুতি নেয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে বিশেষ বিশেষ আমল করতেন। আর রমজানের কামনা বাসনা করতেন। সাহাবিদের মাঝে এ মাসে আমলের নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হতো। আমলের মোহনায় ভাসতো পুরো সমাজ। কেমন জানি কানে বাজত তার আগমন ধ্বনি। আমলে আমলে চলত তাকে বরণ করে নেয়ার প্রাকপ্রস্তুতি। আমাদের আকাবিরেরা এ দোয়া করতেন ‘হে পরওয়ারদিগার রজব ও শাবান মাস আমাদের বরকাত দাও এবং রমজান মাস পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দাও’। এভাবে তারা রজব মাসকে রমজানের প্রস্তুতিমূলক আমলে অতিবাহিত করতেন। সুতরাং এ কথা বলা যায়, ‘রজব মাস মুমিনের দ্বারে রমজানের করাঘাত’ এর মাস।