যুদ্ধ ও শৈশব: বিজয়ের ইতিহাস
নিউজ ডেস্ক

প্রতীকী ছবি
(১)
“একাত্তর আজ গল্প বটে, সযত্নে পাঠ্য লাল মার্জিনের খাতা
গল্প, বীরত্ব আর কপটতা, রক্ত আর মৃত্যুর অবাক কাহিনী মাত্র।“ - খোন্দকার আশরাফ হোসেন
আমার ধারণা স্মৃতি ও পাঠ করা ইতিহাসের মধ্যে প্রবল পরস্পর বিরোধিতা বিদ্যমান। পুস্তকে লিপিবদ্ধ ইতিহাস মূলত অতীতের বিমূর্ত পর্যবেক্ষণ। অতীতের বিস্তার বাড়ার সাথে সাথে এর বিমূর্ততা বাড়তে থাকে। কারণ ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস প্রণয়নের সময়ে অতীতের খুঁটিনাটি তুলে আনেন না বা আনতে পারেন না। কিছুসংখ্যক উল্লেখযোগ্য তথ্য দিয়ে সময়কে সরলীকরণ করে থাকেন। ফলে ইতিহাস অতীতকে প্রতিবিম্বিত করার নিমিত্ত হলেও ইতিহাস সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ অবদান রেখে যাওয়া আসল মানুষেরাও বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়ে যায়।
ইতিহাসকে সহজবোধ্য করার জন্যে সরলীকরণের পাশাপাশি ঐতিহাসিকগণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করার সময়ে উল্লেখিতরা অনুষঙ্গ হিসেবে বাদ পড়ে যান। কারণ ইতিহাস লিখতে গিয়ে তারা প্রথমেই নির্দিষ্ট থিম (Theme) কে উপলক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। এই থিমগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করাই হয়ে উঠে তখন তাদের মুখ্য কাজ এবং সংকলিত ইতিহাসে এই আপাত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা ঘটনা বা ব্যক্তিরাই শুধুমাত্র প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ইতিহাস হিসেবে টিকে থাকে। ফলে মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওহর লাল নেহেরু, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, দেশভাগ, ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, সালাম, রফিক, জব্বার, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণ, ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালের সেই কালো রাত্রি, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় দিবস ইত্যাদি মোটা দাগের শব্দমালাই ইতিহাস হিসেবে রয়ে যায় ভবিষ্যতের জন্যে। এই শব্দমালায় কোন প্রাকৃতজনের নাম, তাদের অংশগ্রহণ বা আনন্দবেদনার প্রতিফলন খুব কমই থাকে। তারা শুধুমাত্র কিছু কাল বিরাজ করে তাদের নিবিড় পরিচিত জনদের স্মৃতিতে। অতঃপর হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে, চিরকালের জন্যে!
অথচ ইতিহাস সংগঠনের মুহূর্তগুলোতে উপস্থিত থাকা কোন ব্যক্তি বা ঘটনাই তুচ্ছ হতে পারে না। একাত্তুরের যুদ্ধের কথাই ভাবুন। যুবক বা কিশোর তার নিশ্চিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করে যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। পিতা-মাতা নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে পাথেয় করে সন্তানকে শত্রুর নির্মমতার শিকার হয়েছে। নারী তার প্রিয়জনকে যুদ্ধে পাঠিয়ে শত্রুর বর্বরতার শিকার হয়ে সম্ভ্রম বা প্রাণ হারিয়েছে। নবীন শিশুরা মুখোমুখি হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। তারপরেও সন্তান হারা জননী মাতৃস্নেহে যোদ্ধাদেরকে রান্না করে খাইয়েছে। বর্ষীয়ান পুরুষ তার শেষ সময়ের অভিজ্ঞান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের পথ বাৎলে দিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসে কখনোই তাদের নাম লেখা হয়নি।
এ কারণেই আমার কাছে ব্যক্তিগত পর্যায়ের স্মৃতির গুরুত্ব বা আবেদন লিপিবদ্ধ ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি। আমার বিশ্বাস শুধুমাত্র স্মৃতির মাধ্যমেই আমরা ইতিহাসের দিন গুলোকে ছুঁয়ে আসতে সক্ষম। স্মৃতি আপাতভাবে জটিল প্রক্রিয়া হলেও এখানে মানুষ, অতীত, প্রিয় পরিচিত জন –সবাই অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে একত্রিত হতে পারে। একারণেই স্মৃতির পথ ধরে আপনি নিবিড়ভাবে সবার চলার পথ ধরে হাঁটতে পারবেন। বিশাল ল্যাবিরিন্থের মতো পথ অনুসরণ করে। বর্তমান বাস্তব পৃথিবীতে বাস করেও আপনি শুনতে পাবেন অন্যদের চলার পদশব্দ। এমনকি আপনার নিজের পদশব্দও শুনতে পারেন। অবাক হবার কিছুই নেই। আসলে স্মৃতি তো শুধুমাত্র অতীতের অবলোকন নয়। এটা দৃষ্টি, শ্রুতি, অতীতকালের বিরাজিত অবস্থা, ভাবনা-চিন্তা – সকলকিছুই মিলেই সংগঠিত হয়। একত্রীভূত সকল তথ্যমালাই স্মৃতি। এরাই আপনার ভেতরে আসল সত্যের উপলব্ধি সৃষ্টি করে।
(২)
১৯৭১ সালে আমি প্রথম শ্রেণীতে পড়ি। বড় ওয়ান। এই সময়কালের সব স্মৃতি আমার মনে নেই। কিন্তু যেগুলো মনে আছে, সেগুলো যথেষ্টই স্পষ্টভাবে মনে আছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত কিছু স্মৃতি আমার স্পষ্টই খেয়াল আছে।
মাসের নাম মনে নেই। কারণ সময়ের বোধটাই তখন পর্যন্ত আমার ভেতরে জন্মায়নি। সম্ভবত জুন অথবা জুলাই মাস হবে। এই সময়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা ঝাড়কাটা নদী পেরিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের বিশাল সবুজ প্রান্তরের ভেতর দিয়ে আমাদের ঝাড়কাটা স্কুলে এসে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলো। এই দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য আমার পূর্বপরিচিত ছিলো। তিনি ছিলেন ঝাড়কাটা স্কুলের সপ্তম অথবা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের পাশের বাড়িতে জায়গীর থেকে ঝাড়কাটা স্কুলে পড়াশুনা করতেন। ভারতীয় একটা এসএমসি (সাব মেসিন কারবাইন) বহন করছিলেন তিনি। অস্ত্রটির শরীরে ছিল অসংখ্য ছিদ্র। আমি ভাবতাম যে, ছিদ্রগুলো দিয়ে একসাথে অনেকগুলো গুলি বের হয়। ফলে ক্ষুদ্র আকৃতির অস্ত্র হলেও এটা দিয়ে একসাথে অনেকগুলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্য বা রাজাকার-আলবদর মেরে ফেলা সম্ভব। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে আসার পরেই এই অস্ত্র সম্পর্কে আমি সম্যক জ্ঞানলাভ করি। এই ছিদ্রগুলো ছিল প্রবাহিত বাতাস দিয়ে অস্ত্রের ব্যারেলকে শীতল করার (Air Cooling System) বাহন।
আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে সেবছর বর্ষাকালের পর আমাদের পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলো ফরিদপুর থেকে আগত এক অধ্যাপক পরিবার। সাথে ছিলো তার এক কিশোর ভাই। নাম মানিক। মানিক ছিলো উচ্ছ্বল এক তরুণ। আমাদের স্কুলের কোণায় সে ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছিল। সেখানে গেলেই আমাদেরকে সে চকোলেট খেতে দিতো। সম্ভবত যুদ্ধের সময়েও অধ্যাপকের পরিবার চেষ্টা করছিল স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এবং সম্মান বজায় রাখতে। এই দোকানের যৎসামান্য উপার্জন হতে।
১৯৭১ সালের শরৎ কালে আমাদের বাড়ির কাছারিঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন যুদ্ধাহত এক মুক্তিযোদ্ধা। সম্ভবত কামালপুরের প্রথমদিকের যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন। উজ্জ্বল চোখের যুবক। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে কাঁধে করে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি তাকে ভাইজান বলে ডাকতাম। তার চেহারা খেয়াল থাকলেও তার নামটা আমার স্মৃতিতে নাই। কোন যুদ্ধে তিনি আহত হয়েছিলেন সেটাও আমি জানি না। ৫/৬ মাস কাল তিনি আমাদের বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। তার ডান পায়ের হাঁটুর ওপরের ঊরুতে একটা বিরাট গোলাকৃতি ক্ষত ছিলো। গুলি তার ঊরু ভেদ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেতেন এবং প্রতিদিন নিজ থেকেই ক্ষতস্থান পরিস্কার করতেন। আমার সাথে তার সম্পর্কটা ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের। অথবা অনুজদের সাথে অগ্রজের যে সম্পর্ক থাকে। তার যুদ্ধে গমন, আহত হওয়া সবকিছু সম্পর্কেই আমি হয়তো সে সময়ে জানতাম। সম্ভবত তিনি আমাকে বলেছিলেন। তবে সেসব স্মৃতিতে নেই। সময় ও বিস্মৃতি ডালপালা মেলে সব ঢেকে দিয়েছে। মনে আছে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। হয়ত বা পুনরায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে। অথবা ইচ্ছে করেই স্মৃতি বা ইতিহাসের অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। আমি জানি না। তবে তিনি আর কোনদিন ফিরে আসেননি।
(৩)
আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে উত্তরে তাকালে দূরে দিগন্তের ওপারে নীলের চেয়েও ঘন নীল একটা পাহাড়ের রিজলাইন দেখা যেতো। সকল সময়ে নয়। শরৎ ও হেমন্তকালে। যেমন এই হেমন্তে উত্তরবঙ্গের তেতুলিয়া হতে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সেটা ছিল গারো পাহাড়ের রিজলাইন। এই পাহাড় অতিক্রম করলেই আসামের মেঘালয় রাজ্য। শিশু হিসেবে বাস্তব পৃথিবীতে এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম দেখা সবচেয়ে বিষ্ময়কর দৃশ্য। ঝাড়কাটা নদী, ঝিনাই নদী এবং ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে তেপান্তরের ওপারে। আমার কাছে সেটাকে মনে হতো অন্য কোনো পৃথিবীর অংশ।
এই গারো পাহাড়ের কাছের একটা জায়গার নাম ধানুয়া কামালপুর। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এখানে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল দলও এখানে কাজ করছিলো। ১১ নং সেক্টরের অধীনে। সীমান্তবর্তী এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে। এই অঞ্চলে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ৩ হাজার ও গণবাহিনীর ১৯ হাজারসহ মোট ২২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ২৮ নভেম্বর সময়কালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর ১০ বার সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধগুলোতে সর্বমোট ১৯৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৪৯৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।
কামালপুর যুদ্ধের বর্ণনা সম্ভবত আমি শুনেছিলাম আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া সেই আহত মুক্তিযোদ্ধার নিকট থেকে। তবে আমার স্মৃতিতে সেই বর্ণনাগুলো নেই। অস্পষ্টভাবেও। তাই এই লেখার তথ্যমালা আমি সংগ্রহ করেছি বিভিন্ন উৎস থেকে। সেনাবাহিনীতে কনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে চাকুরীকালে সামরিক ইতিহাস অধ্যয়নের অংশ হিসেবে এবং সেনাবাহিনীর সিনিয়রদের কাছ থেকে। এমনকি এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকেও আমি অমূল্য তথ্য পেয়েছি।
১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুরের পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপরে আক্রমণ পরিচালনা করে। এই আক্রমণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম কনভেনশনাল যুদ্ধ। সাধারণ নিয়ম হিসেবে নিয়মিত বাহিনীর সদস্যেরাই শুধুমাত্র এই ধরণের অপারেশন পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু এই যুদ্ধে মাত্র ৪ সপ্তাহের বেসিক ট্রেনিং সম্পন্ন করা সিংহ ভাগ (৮০%) তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা অংশ গ্রহণ করেছিলো। কয়েকজন অকুতোভয় সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে। ফলাফল যাই হোক, এই আক্রমণের মাধ্যমে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণের বিনিময়ে প্রমাণ করেছিল যে, দেশের স্বাধীনতার জন্যে অকাতরে তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, রিকোনাইসেন্স (রেকি) পর্যায়ে কিছু বিচ্যুতির কারণে মুল আক্রমণ পরিচালনার সময়ে আক্রমণকারী দল নিপতিত হয়েছিলো পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের সমন্বিত ফায়ারের মুখে।
কামালপুরে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দায়িত্বে ছিলো ৩০ বালুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী। অবস্থানটি তৈরি করা হয়েছিলো শক্ত কংক্রিট দিয়ে। চারপাশে কাটা তারের বেড়া, মাইনফিল্ড এবং পাঞ্জি বিছানো হয়েছিলো। প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনের সকল গাছপালা কেটে পরিষ্কার করা হয়েছিলো, যাতে গুলি করার সময়ে ফিল্ড অফ ফায়ার (Field of Fire) পেতে অসুবিধা না হয়। এর বাইরে ফিল্ড গান ও ৮১ মিঃমিঃ মর্টারের ফায়ার দিয়ে অবস্থানটি সুরক্ষিত করা হয়েছিলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের ১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দুইটি কোম্পানীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এই অবস্থানটি দখল করার। ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানী। ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন ছিলেন কোম্পানীদ্বয়ের অধিনায়ক। আক্রমণের পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে তারা এক রাতে পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা অবস্থান রেকি করতে গেলে ক্যাপ্টেন সালাহুদ্দিনকে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের প্রহরী চ্যালেঞ্জ করে বসে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি প্রহরীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় দুজনের মধ্যে মল্ল-যুদ্ধ। পাক-প্রহরী পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে ডেলটা কোম্পানীর সুবেদার আব্দুল হাই তাকে গুলি করে নিহত করেন। এই গোলাগুলিতে আরো একজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। রেকি দল তাদের কাছ থেকে দুটো জি-৩ রাইফেল হস্তগত করে।
কিন্তু এর ফলে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থান সতর্ক হয়ে যায়। প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপরে বড় ধরণের আক্রমণ হতে পারে ভেবে তারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতা বাড়িয়ে দেয়। প্রতিরক্ষা অবস্থানকে দুর্ভেদ্য করে তোলে। ফলে রেকির মাত্র ৩দিন পর ৩১ জুলাই ১৯৭১ তারিখ রাতে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করার সময়ে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থানের সমন্বিত ফায়ারের মুখে পড়ে। প্রচুর হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন সহ ৩০ জন তরুন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেফটেন্যান্ট মান্নান সহ ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এর পরেও তারা মাইনফিল্ড, পাঞ্জি ও কাঁটা তারের বেড়া অতিক্রম করে প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছতে এবং দুটো বাংকার দখল করতে সমর্থ হন। যদিও পরবর্তীতে তারা তা ধরে রাখতে সক্ষম হননি।
(৪)
পুনরায় স্মৃতিতে ফিরে আসি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ, অথবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে ভারতীয় বোমারু বিমান উড়ে যাচ্ছে। জোড়ায় জোড়ায়। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে। উজ্জ্বল উঠোনের আলোতে উড়ে যাওয়া সেই বিমানগুলো ছিল ঘাস ফড়িঙের মতো দেখতে। সেগুলোর আগমনের পূর্বেই মেঘের গর্জনের মতো শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অথচ আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। প্রতিবারেই আমি প্রবলভাবে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যেতাম।
নভেম্বরের শেষ দিক। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণে ভুগে দুর্বল হয়ে গেছে কামালপুরে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় আর্টিলারি এবং সাঁজোয়া সহায়তা নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করে। ১০ দিনব্যাপী প্রবল যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা আত্নসমর্পন করে। অবরুদ্ধ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার আহসান মালিক খানসহ ১৬২ জন হানাদার বাহিনীর সদস্য প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে সাদা পতাকা উড়িয়ে বেরিয়ে এসে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলার মাটিতে পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর এই প্রথম আত্মসমর্পণ!
এর পরের ইতিহাস বাঙালীদের জয়যাত্রার। ৬ ডিসেম্বর তারিখে মুক্ত হয় দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও শেরপুর। ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় জামালপুর। ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় মিত্রবাহিনীর অপারেশন লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign)। মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত এগিয়ে আসে ঢাকার দিকে। চতুর্দিক থেকে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ফ্রান্স দখলের জন্যে জার্মানদের কর্তৃক পরিচালিত Blitzkrieg অপারেশনের মতো।
১১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকার অদূরে শ্রীপুর। কাদের বাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর বিমান থেকে সাত শতাধিক প্যারাট্রুপার অবতরণ করে টাঙ্গাইলের মাটিতে। উদ্বেলিত জনতা তাদের স্বাগত জানায়। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারা বয়ে নিয়ে যায় তাদের গোলাবারুদ ও সরঞ্জামাদি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য। চারপাশ ক্রমশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে হাজার হাজার মানুষের 'জয় বাংলা' স্লোগানে। এইদিন বিকেল তিন ঘটিকায় অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। সমাপ্ত হয় ৯ মাস ব্যাপী সর্বাত্নক যুদ্ধের। মানুষের আনন্দবেদনার গর্জনের মধ্যে অস্তমিত হয় পাকিস্তানের পতাকা।
পরদিন সকালে কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং অযুত মা-বোনের শ্লীলতাহানির বিনিময়ে আকাশ উজ্জ্বল করে জেগে উঠে স্বাধীনতার সূর্য। রক্তের চেয়েও লাল!
- কবিতা: চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়
- একটা স্কুল মাঠের গল্প
- ‘অদম্য বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প’
- ভয় নয়, কাজ দিয়ে করোনা জয়
- বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৬তম জন্মদিন আজ
- কবি শামসুর রাহমানের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
- নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার উদ্বোধন আজ
- যুদ্ধ ও শৈশব: বিজয়ের ইতিহাস
- আমরা সবাই আসলে মাটির সন্তান (And of Clay Are We Created)
- ৬৬ বছরে পা রাখলো বাংলা একাডেমি