ঢাকা, শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম অর্থনৈতিক তাৎপর্য

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ১৯ নভেম্বর ২০২৩  

গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম অর্থনৈতিক তাৎপর্য

গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম অর্থনৈতিক তাৎপর্য

গ্লোবাল গেটওয়ে হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে যে ধরনের অবকাঠামো রয়েছে, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে ধরনের সমস্যা আছে, সেগুলো মোকাবিলা করার একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, এ উদ্যোগটি এসেছে ইইউ থেকে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলকে যুক্ত করা হবে। সেখানে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করে বিশ্বের যোগাযোগ, সাপ্লাই চেইন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করা হবে।

গ্লোবাল গেটওয়ে ধারণার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, এটি টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেবে, পাশাপাশি ইউরোপের যে মূল্যবোধ, তার ওপর আলোকপাত করবে। এটি এমন একটি ফোরাম যা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের সরকার এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহের বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ, চিন্তাবিদসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংন্থার প্রতিনিধিদের একত্র করে বৈশ্বিক বিনিয়োগ বিশেষত অবকাঠামো বিষয়ক খাতের উন্নয়ন ও পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫-২৬ অক্টোবর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশন আয়োজিত প্রথম গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে যোগ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এ ব্রাসেলস সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য একদিকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, অন্যদিকে বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্কের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশের যত অর্জন যেমন- বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি, বাংলাদেশের জিডিপির আকার গত ১৫ বছরে ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে, দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, একইসঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নেও ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে-এ বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন।

এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ, যেটি কৌশলগতভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে এবং একইসঙ্গে এটি অর্থনৈতিক ও যোগাযোগের আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 
প্রধানমন্ত্রী ফোরামে যোগ দেওয়ার ফাঁকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতার দিকে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশ সফর করার সময় এয়ারবাসের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এ চুক্তির আওতায় ১০টি সুপরিসর বিমান কেনা হবে, যার মূল্য প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের উদীয়মান এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার জন্য এই এয়ারক্রাফট কেনার চুক্তি। বস্তুত বাংলাদেশ-ইইউ সম্পর্ক বর্তমানে অনেক বেশি অংশীদারিত্বমূলক এবং এটিকে একটি উইন উইন কাঠামোর মধ্যে বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইইউর সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা হচ্ছে। এ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার একটি বড় বিষয় বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতি বাস্তবায়ন।
এছাড়াও ছয়টি কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে- বিশ্বকে সবুজ জ্বালানি ও গ্রিন হাইড্রোজেনে রূপান্তর করা, শিক্ষা ও গবেষণা, ক্রিটিক্যাল কাঁচামালের ওপর জোর দেওয়া, যোগাযোগ করিডর নির্মাণ, স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণ করা। ইইউর এ উদ্যোগটি জি-সেভেনের ‘পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের’ সঙ্গেও যুক্ত এবং বলা যায়, এ দুটি উদ্যোগই প্রায় একই ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রহণ করা হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গেটওয়েকে অনেক ব্যাপক পরিসরে বিবেচনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে জি-সেভেনে মূলত: অবকাঠামোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গ্লোবাল গেটওয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের বাইরেও অন্যান্য সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপরে আলোকপাত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে গ্লোবাল গেটওয়ের একটি ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। এটিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি বিকল্প হিসাবেও অনেকে বিবেচনা করতে পারে। এই প্রথম গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের উদ্বোধনী বক্তৃতায় ইইউর প্রেসিডেন্ট ওরসোলা সরাসরি বলেছেন, এ উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি বিকল্প বিশ্বের সামনে নিয়ে এসেছে এবং সেটি বিআরআইয়ের মাধ্যমে একচেটিয়া প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা।

ফলে এটিকে ভূ-রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জায়গা থেকেও বিবেচনার সুযোগ আছে। এ ফোরামে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বক্তব্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বিআরআইয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, পাশাপাশি গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামেরও প্রতিষ্ঠাকালীন সভায় যুক্ত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে ভারসাম্য, সেটি প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে দেখি। এ ভারসাম্য শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূণ। প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, এ অঞ্চলের স্থলবেষ্টিত যে অঞ্চল অর্থাৎ নেপাল, ভুটান ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল, তাদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। 
ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সাড়ে ৪ কোটি ইউরোর একটি অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপীয় কমিশনের মধ্যে একটি ১ কোটি ২০ লাখ ইউরো অনুদান চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এই সফরে বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপীয় কমিশন বাংলাদেশের সামাজিক খাতে ৭ কোটি ইউরোর পাঁচটি বিভিন্ন অনুদান চুক্তি স্বাক্ষর হয়। 
বেলজিয়াম সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী তিন বছরের পরিবর্তে ছয় বছরের জন্য বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে পরবর্তী ধাপে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বেলজিয়ামে সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব এ সফরকালে নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে। গ্লোবাল গেটওয়ের আওতায় বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কানেক্টিভিটি, শিক্ষা, গবেষণা, ডিজিটাল অবকাঠামো এবং চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদনে বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়